আর মাত্র দুই সপ্তাহ পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচন যতই কাছে আসছে ততই নির্বাচনী উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম গণতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতি একটু ভিন্নমাত্রার। ফলে সর্বোচ্চ ভোট পেলেও সে নির্বাচনে নাও বিজয়ী হতে পারে। বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় ইলেক্টোরিয়াল কলেজ ভোট। বিজয়ী প্রার্থীকে অবশ্যই ৫৩৮টি ইলেক্টোরিয়াল ভোটের মধ্যে ২৭০টি ভোট পেতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে ৩২ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ বসবাস করে। সে দেশে ডাকবিভাগের মাধ্যমে ,ই-মেইলে অথবা সরাসরি আগাম ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। করোনাকালিন অনেকেই আগাম ভোট প্রদান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেড়কোটি ভোটার তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। তারপরেও গেল কয়েক বারের ভোটের হিসাব গণনা করতে গেলে দেখা যায় ৬০ শতাংশের বেশি ভোট সেখানে পড়ে না। এবারও তার ব্যত্যয় হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভোটকে আমেরিকাবাসী কখনো উৎসবের মত করে নেয় না। ভোটের দিন দেখা যায় ভোটের আলোচনার চেয়ে তাদের মধ্যে খেলা দেখা এবং খেলা নিয়ে আলোচনা করে সময় কাটাতে।
আমেরিকার নাগরিকরা রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট এই দুই দলে বিভক্ত হলেও কিছু কিছু রাজ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। কলোরাডো, ফ্লোরিডা,আইওয়া,মিশিগান,মিনেসোটা,নেভাদা,নিউহ্যাম্পশায়ার,নর্থক্যারোলিনা,ওহাই, পেনসিলভানিয়া,ভার্জিনিয়া,উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের নাগরিকরা কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত নহে। এই রাজ্যগুলির ভোটাররা নির্বাচনের আগমূহুর্তে সিদ্দান্ত নেয় কোন প্রার্থীকে ভোট দিবে। এই রাজ্যগুলোকে এ জন্য বলা হয় ব্যাটল গ্রাউন্ড বা সুইং ষ্টেট। প্রার্থীরা যে কারণে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এই ব্যাটল গ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতে বেশি প্রচারণা চালায়। এখানকার ভোটারদের কাছে টানার উপরই প্রার্থীর জয় পরাজয় নির্ভর করে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট মনোনীত প্রার্থী হিলারী ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে এগিয়ে থাকলেও এই ব্যাটল গ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতে এসে পিছিয়ে যায়। আবার ভোটের সংখ্যাই ট্রাম্প পিছিয়ে থাকলেও ইলেক্টোরিয়াল কলেজ ভোটে এগিয়ে যায়। দেশী এবং বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে হিলারী ক্লিনটন এগিয়ে ছিল। ভোটের সংখ্যাও ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লক্ষ বেশি ছিল। তারপরেও ভোট পদ্ধতির কাছে গিয়ে পরাজয় বরণ করতে হয় হিলারী ক্লিনটনকে। সে সময় নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে হিলারী ক্লিনটনের বিরুদ্ধে আমেরিকার কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই অবৈধ ই-মেইল ব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে আসলে দ্রুতই ভোটের চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। ভাসমান ভোটারের মাঝে এই বিষয়টি ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং হিলারী ক্লিনটন সম্পর্কে ভোটারদের মাঝে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। ফলে বিভিন্ন দেশী -বিদেশী সংস্থার জরিপে হিলারী ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও শেষ সময়ে গিয়ে ট্রাম্পের ভোটের পাল্লাই ভারী হয়ে যায়। চতুর ট্রাম্প এবারও সেই রকম ভাবেই আমেরিকা বাসীর মনোভাবে পরিবর্তন নিয়ে আসার লক্ষে তার প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী জো বাইডেনেরে ছেলে হান্টার বাইডেনের ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানীর সাথে অবৈধ ই-মেইল ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন। নির্বাচনের আগে সেই অভিযোগটি সামনে নিয়ে এসে ট্রাম্প পরিস্থিতি নিজের নিয়ণÍ্রণে নিয়ে আনার চেষ্ঠা করছেন। কিন্তু অভিযোগটির পক্ষে এখন পর্যন্ত কোন জোরালো তথ্য- উপাত্ত হাজির করতে পারেননি ট্রাম্প বলয়ের লোকজন। বরং করোনা আক্রান্ত নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও কর ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমেরিকাবাসীর মনে ট্রাম্প সম্পর্কে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্ঠি হয়েছে। ফলে সর্বশেষ জরিপে ওহাইতো অঙ্গরাজ্য ছাড়া ৪৯টি অঙ্গরাজ্যে জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। তারপরেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বলয়ের লোকজনের মাঝে বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শেষ সময়ে এসে চতুর ট্রাম্প নিশ্চয় নতুন কোন চমক দেখাতেও পারে।
এদিকে প্রধান বিচারপতি গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর নতুন বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন ট্রাম্প। ইতোমধ্যে এই পদে অ্যামি ক্লোনি ব্যারেটকে মনোনীত করেছে ট্রাম্প। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিবে সিনেট। সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এই নিয়োগে কোন বাধা থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে। এমনিতেই ৮ জন বিচারপতির মধ্যে ৫ জনই রিপাবলিকানদের মনোনীত। অবশিষ্ঠ ৩ জন ডেমোক্র্যাটদের সময়ের নিয়োগ। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বাধা দিয়ে আসছে ডেমোক্র্যাটরা। ট্রাম্পবলয়ের লোকজনের হিসাবটা এই রকম যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল গেল কয়েক বছরের মত এবারেও আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে আদালতের সহানুভ’তি পেলে ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরে আসবে। নির্বাচনের সময় যতই কাছাকাছি আসছে ততই নির্বাচনী উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের মাঝে অস্ত্রকেনার ঝোঁকও বেড়েছে। গেল এক সপ্তাহে ৩৯ লক্ষ অস্ত্র এবং সেই সাথে গুলি ও গোলাবারুদও বিক্রি হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝেই নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ঠ উগ্রতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডেমোক্র্যাট সমর্থিত মিশিগানের গভর্ণরকে অপহরণ করার চেষ্ঠা করা হয়েছিল। অপহরণ চেষ্ঠার এই মামলায় ১৩ জন শ্বেতাঙ্গকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকে এসব ঘটনার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র ও অসহিজ্ঞু আচারণকে দায়ী করেছেন।
ঐতিহ্যগতভাবেই আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যেই ভোটের লড়াইটা হয়ে আসছে। তবে এর ব্যতিক্রম হয়েছে আমরেকিার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের ক্ষেত্রে। তিনি এই দুই দলের বাইরে থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী লাভ করেন। এবারের নির্বাচনে ১ হাজার ২১৬ জন অংশ নিলেও মাঠে রয়েছেন মাত্র দ’ুজন। তারা হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন। এদের বাইরে ১ হাজার ২১৪ জন প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই সব প্রার্থীদের ঁেদৗঢ়ঝাপ তেমন চোখে পড়ার মত নয়। ব্যালট পেপারে এদের নাম থাকবে না। কোন ভোটার মনে করলে ব্যালট পেপারের শূন্য স্থানে পছন্দের প্রার্থীর নামটি উল্লেখ করার মধ্যদিয়ে ভোটটি নিশ্চিত করতে পারবেন।
এসব প্রার্থীদের মধ্যে একজন হলেন জেড সিমন্স। তিনি একজন ভাল বক্তা এবং পিয়ানোবাদক। আমেরিকার শিক্ষা, অর্থনীতি ও ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা সংস্কার করাই তার নির্বাচনের দাঁড়ানোর মূল উদ্দেশ্য। অপর এক প্রার্থী ব্রক পিয়ার্স দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন। তিনি আমেরিকাবাসীর জন্য একটি সুন্দর রাজনৈতিক পরিবেশের আশাবাদী। অপর একজন প্রার্থী মার্ক চার্লস পেশায় একজন প্রযুক্তিবিদ। অশ্বেতাঙ্গদের দাবী আদায়ে তিনি একজন সক্রিয় কর্মী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্ররুপে আত্মপ্রকাশ করে। জাতি সংঘের স্থায়ী সদস্যপদ লাভের মধ্যদিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরী করে নেয় দেশটি। এক সময় পুরো দুনিয়া শাসন করতো আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু নব্বই এর দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর আমেরিকা হয়ে ওঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বি শক্তি। ফলে এখন জাতিসংঘসহ পৃথিবীর যে কোন সংস্থার সিদ্ধান্ত নিতে আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই শক্তিশালী এই দেশটির নির্বাচন নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। ইতোমধ্যে এই নির্বাচনে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বি চীন , ইরান এবং রাশিয়া গভীর দৃষ্ঠি রেখে চলেছে। তালেবানরা ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকার খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না। তারপরেও ব্যক্তি মানুষের মানসিকতা অনেক সময় বড় পরিবর্তনে ভ’মিকা রাখতে সহায়তা করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ প্রীতি এবং অভিবাসন বিরোধী মনোভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের মাঝে বেশ উদ্বেগ ও আতংকের সৃষ্ঠি করেছে। এ ছাড়াও কৃজ্ঞাঙ্গদের বার বার পুলিশ আঘাত করেছে। মোট ভোটারের মধ্যে শতকরা ১৫ ভাগ ভোটার কৃঞ্জাঙ্গ। এই ভোটের বেশির ভাগই ট্রাম্পের বিপক্ষে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
লেখক ঃ হাসানুজ্জামান, সাংবাদিক ও গবেষক।