পহেলা অক্টোবর ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন অধ্যায় রচিত হয়। ১৭৮০ সালের এই দিনে আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি করার জন্য উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদরাসা-ই- আলিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস এ অঞ্চলে অত্যন্ত প্রাচীন। বঙ্গদেশে যারাই ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন, তারাই এখানে ইসলামী শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে জনৈক সাহাবী এ অঞ্চলে আগমন করেন। এছাড়া সাহাবীগণ মহানবী (সাঃ)-এর বিদায় হজের ভাষণে দীন প্রচার ও প্রসারে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। তারা যেখানেই ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন, সেখানেই মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা গড়ে তুলেছেন। যেগুলো ছিল ইসলামী জ্ঞানচর্চার এক একটি উজ্জ্বল বাতিঘর।
উমাইয়া শাসক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের সময় বাংলার প্রাচীন জনপদ রংপুরের কুড়িগ্রাম অঞ্চলে বর্তমানে লালমনিরহাট জেলায় ‘মাজদের আড়া’ নামক জায়গায় ৬৮ হিজরী (৬৯০ খ্রিঃ) ‘হারানো মসজিদ’ নামে একটি মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। জার্মানভিত্তিক রেডিও ডয়েসেভলের এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় এটিই হবে সর্বপ্রথম মসজিদ। মসজিদের প্রাচীন থেকে লিপিতে আরবী ভাষায় ৬৮ হিজরী সনের কথা লেখা রয়েছে।
হিজরী ৯০ সন মোতাবেক ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম ভরতের সমগ্র সিন্ধু অঞ্চলটি জয় করেন। এভাবে হিজরী প্রথম শতকেই ইসলাম ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ১২০০ খ্রিঃ সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে অভিযান পরিচালনা করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করেন মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা। ইতিহাসে পাওয়া যায় তিনি রংপুরেও একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন। এভাবে বাংলাদেশে ওলামা- মাশায়েখ ও মুবাল্লিগগণের অব্যাহতভাবে দীন প্রচার ও মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখানে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটতে থাকে। ম্যাক্সমুলারের মতে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮০ হাজার মাদ্রাসা চালু ছিল। কিন্তু বৃটিশ সরকার বাংলা দখল করে মসজিদ-মাদ্রাসার খরচ নির্বাহের জন্য বরাদ্দকৃত ‘ওয়াক্ফ সম্পত্তি’ বাজেয়াপ্ত করলে মাদ্রাসাগুলো ধীরে ধরে বন্ধ হয়ে যায়।
অতঃপর মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে ও ইংরেজদের প্রয়োজনে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ১ অক্টোবর বৃটিশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। আর এ কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল শ্রেণীর হাজার হাজার আলিয়া নিসাবের মাদ্রাসা। যে মাদরাসাগুলো আজ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে হেরার আলোকরশ্মি কুরআন-সুন্নাহর ইলম বিতরণ করে চলেছে জ্ঞান সুধার সবুজ চত্বরে। অক্টোবরের এ দিনটিতে যেহেতু আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার ঐতিহাসিক পথচলা শুরু। তাই ১ অক্টোবরের এ শুভ দিনটি জাতীয় মাদরাসা শিক্ষা দিবস হিসেবে সরকারি স্বীকৃতির দাবি উঠছে বাংলার বিভিন্ন গগন থেকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে আলিয়া মাদ্রাসাগুলো জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মূলস্রোত ধারায় চলে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয় আশির দশকে। ১৯৮৫ সালে দাখিল এসএসসি সমমানের সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৭ সালে আলিম এইচএসসি সমমান আর ২০০৬ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংশোধিত আইন-০৬ জাতীয় সংসদে পাস হলে ফাযিল ও স্নাতক ও কামিল স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা লাভ করে। এছাড়া ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ হতে দেশের বিভিন্ন আলিয়া মাদ্রসায় ফাযিল স্নাতক অনার্স কোর্স চালু হয়।
তৎকালীন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছিল মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, তাহজীব-তমদ্দুন, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনা ৷ এই মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার আলেমে দ্বীন সৃষ্টি হয়েছেন ৷ যারা পরবর্তীতে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেন ৷ দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং মাদরাসাগুলোর বিকাশ সাধনে বর্তমানে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো পূরণের আশু প্রয়োজন।
১.প্রত্যেক গ্রামে একটি করে ইবতেদায়ী মাদরাসা এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা প্রদান।
২. মাদরাসা ছাত্রদের বৃত্তির সংখ্যা এবং টাকার পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. প্রতিটি জেলায় একটি করে মডেল মাদ্রাসা স্থাপন এবং একটি করে ফাযিল/কামিল মাদ্রাসা সরকারিকরণ।
৪. মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর স্থাপন ও একটি স্বতন্ত্র টেক্সট বোর্ড প্রতিষ্ঠাকরণ।
৫. ঢাকা বিভাগের বাইরে আরও পৃথক দু’টি মাদরাসা বোর্ড স্থাপন।
৬. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে মাদরাসা ছাত্রদের ভর্তিবৈষম্য দুর করে যোগ্যতার ভিত্তিতে সকল বিষয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিতে হবে।
৭. মাদরাসা শিক্ষকদের দক্ষ ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষে প্রত্যেক জেলায় একটি করে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে।
৮. ১ অক্টোবরকে জাতীয় মাদরাসা শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা প্রদান।
৯. কামিল স্নাতকোত্তর পাস শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা যথা-এমএড, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভের সুযোগদান।
১০.মাদরাসা প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যবাহি পোষাক পাঞ্জাবী-টুপি এবং রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ দাড়ির খোলস ব্যবহার করে নাটক সিনেমায় খলনায়কদের অভিনয় সহ সকল অপকর্ম নিষিদ্ধ করতে হবে।
১১.চাকুরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দুর করতে হবে।
১২.অনার্স এবং মাস্টার্স পর্যায়কে যত দ্রুত সম্ভব এমপিও ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
১৩.ফাজিল ও কামিলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি বাধ্যতামুলক করতে হবে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হলে আলিয়া মাদ্রাসাগুলো অতি সহজে পৌঁছে যাবে তার পূর্ণাঙ্গ অভিষ্ট লক্ষ্যের সোনালী সোপানে।
লেখক: হাফেজ ইমদাদুল হক
কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা, বাংলাদেশ মাদ্রাসা ছাত্রকল্যাণ পরিষদ ও
সাবেক শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।