বরগুনার আলোচিত শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মিন্নিসহ ছয় আসামির মৃত্যুদ- ও চারজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। বুধবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান।
ফাঁসির দ-প্রাপ্তরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)।
এছাড়া এ মামলায় চার আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়েছে। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।রায় ঘোষণার সময় দ-প্রাপ্ত রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি, আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর এবং কামরুল ইসলাম সাইমুন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ভূবন চন্দ্র হালদার বলেন,আমরা আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট। নিহত রিফাত ফরাজি বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ আদালতের রায়ে সন্তষ্ট প্রকাশ করে বলেন,আমি আমার ছেলের হত্যার সঠিক বিচার পেয়েছি।
মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন বলেন,আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। এ রায়ে বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। উচ্চ আদালতে আমার মেয়েকে নির্দোশ প্রমান করতে পারবো।রিফাত ফরাজি বাবা আহসান হাবিব দুলাল ফরাজি রায় ঘোষনা পর আদালত চত্তরে বলেন আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। মিন্নির পক্ষের আেইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম জানিয়েছেন, তারা মিন্নির পক্ষে আপিল করবেন। আপিলে মিন্নি খালাশ পাবেন বলে তিনি আশাবাদী।
এদিকে রায়কে কেন্দ্র করে আদালত পাড়ায় কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরী করেছে পুলিশি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে জজ কোর্ট হয়ে সার্কিট হাউস পর্যন্ত নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে রেখে ছিল নিরাপত্তা বাহিনী। বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান জেলা গোয়েন্দা পুলিশের প্রহরায় সকাল ৭.১৫ মিনিটের সময় আদালতে প্রবেশ করেন। রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান স্বাক্ষী থেকে আসামী হওয়া আয়শা সিদ্দিকা মিন্নী সকাল ৮ টা ৫৫ মিনিটে তার বাবার মটরসাইকেলে করে আদালতে প্রবেশ করেন। বাকী ৮ আসামীকে কারাগার থেকে ১১টা ৫২ মিনিটে আদালতে আনা হয়।এরপর বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান দুপুর ১টা ১৫মিনিটে মামলার রায় পড়া শুরু করে পৌনে ২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষনে আদালতের বিচারক বলেন,প্রকাশ্য দিবালোকে সনাতনী অস্ত্র রামদা ও দ্বারা কোপাইয়া সংঘঠিত এই মামলার নির্মম হত্যাকান্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানাইয়াছে।উক্ত নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটনকারী আসামীরা প্রত্যেকে যুবক। তথ্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে যুব সমাজ সহ দেশ বিদেশেন সব বয়সের মানুষ তাহাদের উক্ত নির্মমতা প্রত্যক্ষ করিয়াছে।আদালত আরো বলেন,তাহাদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি না হইলে তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের যুবসমাজ ভ’ল পথে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা হওয়ার আশঙ্কা থাকিবে।তাই আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্চনীয়।
রায় ঘোষনা পর আদালত চত্তরে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামীদের আত্মীয় স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। রায় ঘোষনার পর আদালত কড়া প্রহরায় আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে একটি কালো মাইক্রোবাসে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচজন আসামীকে পুলিশ ভ্যানে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এসময় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী রিফাত ফরাজি পুলিশ ভ্যানের ভিতরে বসে চিৎকার করে বলেন আল্লায় বিচার করবে।জানা যায়, গত বছর ২৬ জুন বরগুনা সরকারী কলেজের সামনের সড়কে নয়ন বন্ড ও তার বন্ধুরা রিফাত শরীফকে ধারালো চা পাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ২৭ জুন বরগুনা থানায় নয়ন বন্ডকে প্রধান আসামী করে ১২ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২ জুলাই সন্ত্রাসীদের গুলিতে নয়ন বন্ড নিহত হয়। পরবর্তিতে ওই বাদী ৬ জুলাই মিন্নিকে আসামী করার জন্য বরগুনা থানায় একটি আবেদন করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরির্দশক মো. হুমায়ূন কবির ১৬ জুলাই আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার করেন। ১৯ জুলাই মিন্নি ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। মিন্নিকে বরগুনা জেলা জজ ৩০ জুলাই জামিন না মঞ্জুর করলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর হাই কোর্টে জামিনের আবেদন করেন। আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে হাই কোর্ট ২৯ আগষ্ট জামিন দেয়। রাষ্ট্র পক্ষ মিন্নির জামিন বাতিল চেয়ে সুপ্রীম কোর্টের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেন। চেম্বার জজ ২ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। সেই অবধি মিন্নি জামিনে রয়েছে।
১৬ সেপ্টেম্বর প্রাপ্ত বয়স্ক ১০ আসামির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক, যুক্তিতর্ক খন্ডন ও উচ্চ আদালতের আইন আদালতে উপস্থাপন শেষ হওয়ার পর এ রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারক।আসামী মো. মুসা পলাতক রয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৭৬ সাক্ষ্য দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, রিফাত হত্যা মামলায় ২৪ জনকে আসামি করে দুটি ভাগে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর চার্জশিট দেয় তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ মামলায় ২ মাস ৬ দিন তদন্ত করে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর দুই খন্ডে ২৪ জন আসামীর বিরুদ্ধে বরগুনা সদর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৪ জন শিশু আসামি। এর মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক ১০জন আসামী তারা হল, রাকিবুল হাসান রিফাত শরীফ, আল কাইয়ুম রাব্বি আকন, রেজোয়ানুল ইসলাম টিকটক হৃদয়, হাসান, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, সাগর, আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি, কামরুল হাসান সায়মুন, মোহাইমনিুল ইসলাম সিফাত ও মুছা। ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে নয়ন বন্ডের গড়া কিশোর গ্যাং বন্ড গ্রুপ। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দুই জুলাই মামলার প্রধান আসামী নয়ন বন্ড সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হয়।