করোনকালে সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে চাকরিচ্যুতির ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নারী সাংবাদিকদের অধিকার লঙ্ঘন, হয়রানি, নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিকতায় যুক্ত নারীরা। তারা বলেছেন, করোনার ঝুঁকি নিয়ে নারীরা পুরুষের সমানতালে কাজ করছেন। অথচ গণমাধ্যমগুলোর ‘সংবাদকর্মী ছাঁটাই নীতির’ প্রয়োগ শুরুই হচ্ছে নারী কর্মীদের চাকরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে। মফস্বল পর্যায়ের সাংবাদিকদের, বিশেষ করে নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। প্রায় সব মিডিয়া হাউসই মফস্বলের সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা বন্ধ অথবা অর্ধেকেরও কম দিচ্ছে। কিন্তু মফস্বল সাংবাদিকদের কাজ থেমে নেই। তাঁরা প্রায় সবাই এখন বিনা বেতনে কাজ করছেন।
’করোনা দুর্যোগে নারী সাংবাদিকদের দুর্ভোগ : সাংবাদিকতায় নারীর টিকে থাকা’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আলোচনায় এসব অভিযোগ উঠে এসেছে। ওয়েবিনারে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত ও চাকরিচ্যুত প্রায় ১০০ সাংবাদিক অংশগ্রহন করেন। তাঁরা তাঁদের অধিকারহীনতা, বঞ্চনা ও পেশা নিয়ে হতাশার কথা জানান। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ রাতে এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে। আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু, অনলাইন পোর্টাল জলেশ্বরী ডটকমের সম্পাদক লাইলী বেগম, সিনিয়র সাংবাদিক মারিয়া সালাম, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মৌসুমি আচার্য, ও ফারহানা নীলা।
অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা বলেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য থেকে শুরু করে পদোন্নতিতে বাধা, প্রতিকূল কর্মপরিবেশ, যৌন হয়রানি- এ ধরনের বহু প্রতিবন্ধকতা পার হয়েই সাংবাদিকতা করতে হয় নারীদের। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর সাথে নতুন করে আরও সমস্যা যুক্ত হয়েছে। পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য প্রাথমিকভাবে নিজেদের সংগঠিত হওয়া জরুরী বলে মনে করছেন নারী সাংবাদিকরা। তাঁরা বিকল্প গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এর পাশাপাশি নারী সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষায় সাংবাদিক সংগঠন ও সরকারকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা ।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, ’’নারীদের জন্য সাংবাদিকতা এমনিতেই চ্যালেঞ্জিং। কারণ সাংবাদিকতাকে মূলত পুরুষের পেশা বলে মনে করা হয়। তাই সমাজ, পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে অযাচিত অনেক বাধার সম্মুখিন হতে হয় নারীদের। তারপরও নারীরা আগের তুলনায় সাংবাদিকতায় অনেক এগিয়ে এসেছেন।’’ তিনি বলেন, ‘’জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা আরও বেশি নির্যাতন, অবহেলা এবং বৈষম্যের শিকার। এর থেকে উত্তরণের জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ এবং সংগঠিত হওয়ার কোন বিকল্প নাই।’’ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের দেয়া রায় পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করে প্রতিটি মিডিয়া হাউসে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেল’ গঠনের দাবি জানান তিনি।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন থেকে সম্প্রতি অন্যায্যভাবে চাকরিচ্যুত হন সাংবাদিক মৌসুমি আচার্য। অনুষ্ঠানে মৌসুমি বলেন, ’’গত দুই দশকে টেলিভিশন শিল্পের যে প্রবৃদ্ধি সেই তুলনায় এর ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্বের মান শূন্য। কর্মীদের অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে চ্যানেল মালিকদের ন্যূনতম জবাবদিহি নেই। এই দীর্ঘ সময়েও টেলিভিশন সাংবাদিকদের জন্য কোন ওয়েজ বোর্ড, পদ ও বেতনের গ্রেডিং বা চাকরির বিধিমালা কিংবা মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা করা যায়নি। অথচ কোন সংবাদকর্মী যখন নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তখন তার কাছ থেকে শতভাগেরও বেশি পেশাদারিত্ব আশা করা হয়।’’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘’বাংলাদেশে সাংবাদিকতার যারা পথিকৃৎ তাঁরা এই পেশার প্রতি তরুণদের ভালোবাসা তৈরি করতে পেরেছেন। কিন্তু এই পেশায় পেশাদারিত্ব বা চাকুরির নিশ্চয়তা তৈরি করতে পারেননি। সাংবাদিক সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে । ‘’
পেশাগত কারণে একাধিকবার হামলা ও হুমকির শিকার হলেও সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে পাশে পাননি সাংবাদিক ও অনলাইন পোর্টাল জলেশ্বরী ডটকমের সম্পাদক লাইলী বেগম। উল্টো চাকরিচ্যুত হয়েছেন। লাইলী বলেন, ’’নারী হওয়ার কারণে আমি আরও বেশি হয়রানির শিকার হয়েছি। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চিকিৎসার জন্য অফিসের অনুমতি নিয়েই বিদেশে যাই। সেখানে অবস্থানের সময়ই আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয় ।‘’ তিনি বলেন, ‘’বন্যা ও করোনার কারণে মফস্বলের সাংবাদিকরা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কাজ করছেন। অথচ তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে না।’’তিনি বলেন, “বিনা নোটিশে ও অকস্মাৎ চাকুরিচুত্য নারী সাংবাদিকরা তাৎক্ষনিক “আইডেন্টিটিট ক্রাইসিসে পড়ছেন”।
কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়রানির প্রতিবাদ করার পর বিনা নোটিসে চাকরিচ্যুত হন সাংবাদিক ফারহানা নীলা। তিনি বলেন, ‘’আমি দমে না গিয়ে মামলা করি। কিন্তু এর ফল হয়েছে এই যে, এখন অন্য কোন মিডিয়া হাউস আমাকে চাকরি দিতে চায় না। আইনী লড়াইয়েও এখন কেউ পাশে নেই। প্রতি মাসে একাই কোর্টে যাচ্ছি ।’’
একটি জাতীয় দৈনিকের ইংরেজি অনলাইন সংস্করণের ইনচার্জ হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মারিয়া সালাম। করোনার অজুহাতে ওই গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ ইংরেজি অনলাইন সংস্করণটি বন্ধ করে দেয় এবং মারিয়াকে অন্যায়ভাবে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠায়। মারিয়া বলেন, ‘’সাংবাদিকতায় শীর্ষপদে নারীর অবস্থানের ক্ষেত্রে তার যোগ্যতার চেয়ে চরিত্রহননের আলোচনা বেশি গুরুত্ব পায়। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী সাংবাদিক পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। যে কোন পেশাতেই নারীর প্রতি এই সামাজিক ও মনস্তাত্বিক নেতিবাচক অবস্থান পাল্টাতে হবে। নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে নারীকে, হতে হবে সহমর্মী। এ ক্ষেত্রে পুরুষ সাংবাদিকদেরও নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে’’