ভারত এবং চীনের লাদাখ সীমান্তে আবারো উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। গোলাগুলিও হয়েছে। সীমান্তে উভয় দেশ প্রচুর সংখ্যক সেনাসহ ভারী সামরিক সরঞ্জামের সমাবেশ ঘটিয়েছে। বেশ কয়েকবার দু’দেশের সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের মাঝে বৈঠক হয়েছে, বৈঠক হয়েছে স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রিদের মাঝে। তাতে বাস্তবে শুভ ফল বয়ে নিয়ে আসেনি।
ভারতে চীনের ব্যাপক ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। ভারতীয় বাজার প্রায়ই দখল করে নিয়েছিল চীনা পণ্যে। সেই ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর সীমান্তে ছোটখাট সংঘর্ষ ছাড়া দ’ুদেশের মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভাল হয়ে উঠেছিল। ১৯৯৬ সালে ভারত-চীনের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের কমপক্ষে দ’ুকিলোমিটারের মধ্যে অস্ত্র বহনের নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই সু-সম্পর্কের কারণেই চীনা প্রেসিডেন্ট ভারত ভ্রমণের মধ্যদিয়ে চলমান সম্পর্ক আরো গভীর হয়।
কিন্তু চলতি বছরের জুনে লাদাখের গলওয়াল নদী সংলগ্ন উপত্যক্ষায় দু’দেশের সৈন্যদের মাঝে প্রথমে উত্তেজনা পরে হাতাহাতি থেকে লাঠালাঠি হয়। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছাড়াই এই সংঘর্ষে একজন কর্ণেলসহ ভারতের ২০ জন জোয়ানের নিহত হওয়ার মধ্যদিয়ে দু’দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন লক্ষণ মিলছে না। সম্পর্কের অবনতির জন্য একে অপরকে শুধু দোষারোপ করে চলেছে।
ভারতের সাথে সীমান্ত নিয়ে সমস্যা শুধু চীনের সাথে নয় । সমস্যা রয়েছে পাকিস্থান এবং নেপালের সাথেও। বাংলাদেশের সীমান্তে প্রতিনিয়ত হত্যাকান্ড এবং পদ্মা , তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ নিয়ে ভারতের সাথে সমস্যা রয়েছে। অর্থ্যাৎ ভারতের প্রতিবেশী প্রতিটি রাষ্ট্রের সাথে সীমান্ত সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।
ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার পিছনে রয়েছে ভারতের অর্ন্তগত অরুণাচল প্রদেশের মালিকানা নিয়ে। চীন বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে এই প্রদেশ নিজেদের বলে দাবী করে আসছে। ব্রিটিশরা চীন এবং ভারতের সীমান্ত রেখা টানতে চাইলে সেই সময় চীন অরুণা প্রদেশকে প্রথম নিজেদের বলে দাবী করে। সেই দাবীর সূত্র ধরেই চীন ১৯৫৯ সালে প্রথম এবং ১৯৬২ সালে দ্বিতীয়বার অরুণাচল প্রদেশ আক্রমণ করে। সেই সময় চীনের চৌকষ বাহিনী অরুণাচল প্রদেশের একটি অংশ দখল করে নিলেও বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। বিশ্বে চীনের এই আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এক সময় চীন সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু সরে আসলেও তাদের পূর্বের দাবী রয়েই গেছে।
ভারতের অর্ন্তগত ৮৩,৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এই অঙ্গরাজ্যের বর্তমানে লোকসংখ্যা ১০ লাখেরও বেশী। প্রদেশটির দক্ষিণে অসম, পশ্চিমে ভুটান, উত্তরপূর্বে গণচীন এবং পূর্বে মিয়ানমার। উত্তরে তিব্বতের সাথে হিমালয় পর্বতের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। ব্রক্ষ্যপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রদেশটিতে ১৭ শতকে নির্মিত বৌদ্ধবিহার তাওয়াং মঠ যেখানে দালাইনামার জন্ম হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভ’মি এখানে কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে প্রচুর ধান,গম,যব, বজরা, ডাল, আলু, আখ উৎপাদন হয়। ১৯৮৬ সালে ভারত এটিকে অঙ্গরাজ্যের স্বীকৃতি দিলেও চীন এই রাজ্রটির বরাবরই নিজেদের বলে দাবী করে আসছে। এই অমিমাংশিত বিষয়টি নিয়ে ভারত এবং চীনের মধ্যে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায় ? একদিকে কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত-পাকিস্থানের মধ্যের সাংঘর্ষিক দ্বন্ধ অব্যাহত রয়েছে। মাঝে মধ্যে এই দ্বন্ধ সামরিক সংঘর্ষে রুপ নেয়। ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রাণ ঝরে গেছে। অপরদিকে নেপাল ভারতের অর্ন্তগত কিছু জায়গা নিজেদের দাবী করার মধ্যদিয়ে নতুন সমস্যা তৈরী হয়েছে। নেপালের সাথে ভারতের সেই আগেকার সম্পর্ক এখন আর নেই। এই সব সমস্যা ভারতের অগ্রযাত্রার জন্য নিঃসন্দেহে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ঠি করেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ কি ভাবে সম্ভব , বিষয়টি সহজ মনে হচ্ছে না। ফলে ভারত-চীন যুদ্ধ শুরু হওয়াটা এখন আর কাল্পনিক কিছু নয়। এদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও করোনা মোকাবেলায় সাফল্যের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে চীন। চীন বিশ্বে একটি প্রভাব বলয় তৈরীতে এগিয়ে চলেছে। চীনের বলয় যতই শক্তিশালী হয়ে উঠবে সেটা হবে ভারতের জন্য একটি অশনিসংকেত।এদিকে আগে থেকেই ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভাল নয়। কাশ্মীরের বিষয়টি সহজে মিমাংসা হওয়ার নয়। ভারত তার প্রতিবেশীদের সাথে ইচ্ছা করলেও সীমান্ত সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারছে না। এ অবস্থায় ভারতের সাথে বিশেষ করে চীন এবং পাকিস্থানের যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব যাবে বলে মনে হয় না। এর সাথে ভারতের বিপক্ষে নতুন করে অবস্থান নিয়েছে নেপাল। সবমিলিয়ে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। যুদ্ধ শুরু হলে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলির মধ্যে মেরুকরণের আভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পারমানবিক শক্তিধর এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে এক ভয়াবহ পরিস্তিতির উদ্ভব ঘটবে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এমনিতেই নানা মেরুকরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারত-চীনের এই যুদ্ধ বিশ্ব পরিস্তিতিকে কোনদিকে নিয়ে যাবে তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।
লেখকঃ হাসানুজ্জামান, সাংবাদিক, শিক্ষক।