কোয়ারেনটিন । এই শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত। এর অর্থ সঙ্গনিরোধ। অর্থাৎ অন্য দের থেকে নিজেকে দূরে রাখা। এবার করোনা ডিউটি শেষে আমার কোয়ারেনটিন এর পালা।
ডাক্তারি করতে গিয়ে রাত বিরেতে হাসপাতালে থাকা , বাইরে থাকা বা ব্যস্ততা। এটা আমার দু ছেলে দেখে অভ্যস্ত। তবে একটু লম্বা সময় এর জন্য একেবারে আলাদা থাকা ওরা দেখেনি। ছোট ছেলে চিন্তিত আমাকে না পেলে ওর গ্যাজেট সংক্রান্ত সমস্যা এর সমাধান কে দেবে। তবে বড় ছেলে একটু চাপা। সে তার ভাবনা, আবেগ ঠিক করে প্রকাশ করতে পারছেনা। তবে তার আচরণে আমি অস্থিরতা বেশ বুঝতে পারছি।
শুক্রবার বিকেলে বাসা থেকে বের হলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তবে যাবার দুদিন আগে থেকে বাবার বেশ জ্বর আর কাসি।ওষুধ দিয়েছি যদিও। আর আগের রাতে মা মাথা ঘুরিয়ে পরে আঘাত পায়। মাথার এক অংশ কেটে যায়। তড়িঘড়ি করে আমি হাসপাতালে নিয়ে নিজের হাতে সেলাই করি সেটা। এই ব্যাপারগুলোর জন্য একটু চিন্তা হচ্ছিল অবশ্য।
হোটেলে থাকা একটা আলাদা মজা আছে। যদি সেটা ভালো মানের হয়। তবে এখন সেটা অনুভবের কোনোই মানুষিক অবস্থা কারোরই নেই। এটা ছিল একটা দায়িত্ব, একটা যুদ্ধের অবস্থা। প্রমোদ ভ্রমণ এর কোনো লেশমাত্র ছিল না।
আমরা নির্ধারিত সময়ে হোটেলে উঠলাম। পরিচিত হলাম অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে। কে কিভাবে কাজ করব সেসব নিয়ে সমন্বয় আর আলাপ হল। ব্যাক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী নির্ধারিত ছিল সবার নাম অনুযায়ী। সেটা সংগ্রহ করি।
আর হোটেলে থাকার জন্য কিছু জিনিস সাথে আনি। এরমাঝে একটা ছিল বালতি। এটা মূলত কাপড় ধোবার জন্য। হোটেলের লন্ড্রি ব্যাবহার করতে গেলে ফতুর হতে হবে। একটা শার্ট ধুতে প্রায় তিনশত টাকা। যাইহোক এই বালতির আরেকটা মাহাত্ম্য ছিল যেটা হোটেলে প্রবেশের সময় টের পাই। আমি হোটেলের প্রধান ফটক এর কাছে এসে নামলাম। হোটেলের গার্ড আমাকে দেখেই বুঝে ফেললো আমি করোনা ডিউটি করার জন্য এখানে এসেছি। আমার সেই বালতি ছিল ট্রেড মার্ক। কারণ সব ডাক্তার একটা করে নিয়ে এসেছে।
করোনা ডিউটি করার জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হোটেলে আমরা উঠি। থাকার বন্দোবস্ত ভালো। তবে খাওয়া ছিল এক ঘেয়ে। এখানে ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে আমাদেরকে হোটেলের উন্নত খাবার দিচ্ছিল। খাওয়া মেনু ছিল প্রায় নির্দিষ্ট। তিন বেলা খাবার দিয়ে যায়। সকালে মোটা পরোটা সঙ্গে তেল ফ্রি, আর ডিম ভাজি। দুপুরে রুই মাছ সঙ্গে মসলা ফ্রি। আর রাতে ব্রয়লার মুরগি এবার সঙ্গে তেল মশলা দুটো ফ্রি।তেল মশলা মিশ্রিত খাবার প্রথম দু তিন দিন ভালই লেগেছিল। পরে একেবারেই এক ঘয়ে অবস্থা। ঝাল আর তেল দিয়ে একাকার। কেউ কেউ খেত না। পরে অবশ্য ভালো আর ভিন্ন স্বাদের খাবার মাঝে মাঝে দিতে লাগলো।
ডিউটি শেষে সময় গুলো স্থবির হয়ে থাকতো। ঘড়ির কাঁটা যেনো রুমের ভেতর এক জায়গায় থেমে গেছে। কতক্ষন আর টিভি বা মোবাইল নিয়ে সময় কাটে। যদিও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হতো ফোন আর ভিডিও কল করে। আর সময় কাটত রোগীদের বা পরিচিত অপরিচিত দের করোনা সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে। আর পরবর্তী ডিউটি নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করা হতো। অনেক সময় রোগীদের ফোনের জন্য নিজের পরিবারের লোক আমাকে ফোন করে পেত না। এতে তাদের মন ক্ষুন্ন হয় অনেক সময়। তবে সব থেকে কস্ট পাচ্ছিল ছেলে দু টি। তাদের আবদার জলদি বাসায় ফেরার। ভিডিও কল এই আবদার কান্না আর হাসির।
সাধারণত আমরা যে যার রুমেই থাকতাম। অন্য রুমে যেতাম না। কখনো কখনো দেখতাম কেউ কেউ উদাস দৃষ্টি দিয়ে লবিতে দাড়িয়ে দূরের কিছু দেখছে। যদি এটা কোনো ডিউটি না হয়ে ভ্রমণ হতো তবে এমন লাগতো না। আমরা দিন গুনতাম , কবে আমাদের করোনা টেস্ট হবে। আর কবে হবে মুক্তি। তবে আমার মন প্রায়শই আচ্ছন্ন করে রাখতো রোগীদের আর স্বজনদের আহাজারি কথা ভেবে। কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করতাম এই সংকট যেনো দ্রুত কেটে যায়।
আবার নিজেকে নিয়েও শঙ্কা থাকতো। করোনা রোগীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে ছিলাম আমি। যদিও সুরক্ষা পোশাক ছিল। এরপরেও কোনো বিপদ হলো কিনা ,এটা ভাবতাম। যেসব ডাক্তার চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন , তারা সবাই সুরক্ষা পোশাক পরেছিলেন।এরপরেও শেষ রক্ষা হলো কই। জানিনা আমিও আক্রান্ত হব কিনা।
এরপর হোটেলে থাকা অবস্থায় জানা গেলো সামনের মাসেই আবারও এই ডিউটি পেতে যাচ্ছি। আমরা প্রস্তুত। তবে এবার বোধ করছি পরিবারকে মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হবে। তারপরেও দায়িত্ব পালনে পিছুপা হবনা। করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় আমরা সদা তৎপর।
অবশেষে হোটেল জীবন শেষ হল। ফিরলাম নিজ গৃহে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে একটা কামরা ধীরে ধীরে একটা ঘরে পরিণত হয়। ছেড়ে যাবার সময় কিছু হলেও খারাপ লেগেছিল। মানুষ খুব সহজেই স্মৃতিকাতর হয় যায়। অল্পেই ভালোবেসে ফেলে , হোক না সেটা একটা নির্জীব নিষ্প্রাণ চার দেঁয়াল।
সেরাজুস সালেকিন।
বক্ষ ব্যাধি সার্জন থোরাসিক সার্জারি বিভাগ
সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল।