রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে সম্প্রতি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগীর করুণ মৃত্যু হয়েছে কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির কারণে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি বলছে, হাসপাতালের ত্রুটিপূর্ণ ও পুরনো এসির বিস্ফোরণেই আগুনের সূচনা হয়। গত ২৭ মে রাতের এ ঘটনার পর অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিল, শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।
আজ সোমবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি। সূত্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতিবেদনে ৫ জনের প্রাণহানির জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালটির করোনা ইউনিট এবং এর আশপাশে অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টিও উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এদিকে আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অগ্নিকাণ্ডে মালিকপক্ষের অবহেলা ছিল প্রমাণ হলে ২ থেকে ৫ বছরের সাজা এবং অর্থদণ্ড হতে পারে দায়ীদের।
গতকাল রবিবার বিকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকা-ের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়েছে। সোমবার (আজ) প্রতিবেদন হাতে পাব। এরপর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যের বরাত দিয়ে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, দুর্ঘটনা একটি বিষয়। আর কর্তৃপক্ষের অনিয়মের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া আরেক বিষয়। ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ছিল। কারণ রোগীর চিকিৎসায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও দায়সারাভাবে ইউনিটটি তৈরি করেছিল তারা। হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে অস্থায়ীভাবে তৈরি ওই ইউনিটের পার্টিশনগুলো ছিল পার্টেক্স জাতীয়, যা অতিদাহ্য। হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে স্থাপিত করোনা ইউনিটে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। মূল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের অধিকাংশই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। জরুরি পানির উৎস (হাইড্রেন্ট) থাকলেও তা চালানোর জন্য নির্দিষ্ট করা ব্যক্তি ঘটনার সময় হাসপাতালে ছিলেন না।
যে পাঁচজন মারা গেছেন তারা ইউনিটের সানসেটের ঠিক নিচে ছিলেন। আর বাইরে একটা এক্সটেনশন ছিল টিনশেডের। এসির বিস্ফোরণ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একসঙ্গে পুরো ইউনিটে আগুন লাগার কারণে চিকিৎসাধীন ৫ রোগীর কেউই বের হতে পারেননি। ইউনাইটেড হাসপাতালের যেখানে করোনা ইউনিটটি করা হয়েছে সেখানে এমন পরিস্থিতির মধ্যে রোগীদের রাখা হয়েছিল, যেখানে সামান্য ভুল থেকে আরও আগেই বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।
এদিকে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারামতে, যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধজনক নরহত্যা বলে গণ্য নয় এ রকম কোনো বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজ করে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, সে ব্যক্তি ৫ বছর করাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। জুরিস্প্রুডেন্স ও টর্ট আইনানুসারে অবহেলা বলতে অপরাধমূলক যত্নহীনতা, অসাবধানতা, অমনোযোগিতা, অসর্তকতা বা উদাসিনতাকে বোঝায়।
অন্যদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ১৯০৮-এ বলা হয়েছে, এ আইনের আওতায় কোনো বিস্ফোরণ সংঘটন অথবা বিস্ফোরণ সংঘটনে সাহায্য করে এমন যে কোনো ধরনের সামগ্রী, যন্ত্রপাতি অথবা যন্ত্রাংশের সাহায্যে যদি এমন বিস্ফোরণ ঘটানো হয় যা জীবনহানি ঘটায়, মানুষের জীবন অথবা সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো অপরাধ সংঘটন কিংবা অপরাধ সংঘটনে অন্যকে সুযোগ করে দেয়, তবে তা এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রাভেদে শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা কমপে ২ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদানের সুযোগ রয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডে ৫ রোগীর মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আইনের পুরোপুরি ব্যত্যয় ঘটিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা সনদ না নিয়েই বর্ধিত আইসোলেশন ওয়ার্ডে তাচ্ছিল্যপূর্ণভাবে দাহ্যবস্তু সংরক্ষণ করে অবাধে ব্যবসা বা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন রোগীদের। ফলে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান উপপরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দেবাশীষ বর্ধণ জানান, প্রতিবেদন তৈরিতে চিকিৎসক, নার্স, সিকিউরিটি, হাউস কিপার, তড়িৎ প্রকৌশলী, এসির মেকানিক, রোগীর স্বজন, হাসপাতালে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ২০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া বিভিন্ন আলামত ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ওই আইসোলেশন ইউনিটে একটি পুরনো এসি স্থাপন করা হয়েছিল। সেটি বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। অগ্নিকাণ্ড ও রোগীদের মৃত্যুর নেপথ্যে কর্তৃপক্ষের মারাত্মক গাফিলতি ও অবহেলা খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সেগুলো রিপোর্টে থাকবে। এ ছাড়া আগুন লাগার সুনির্দিষ্ট কারণসহ তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার খুঁটিনাটি, হাসপাতালে কী ছিল, কী ছিল না সেগুলো উঠে আসবে। প্রতিবেদন তৈরির আগে গুলশান বিভাগ পুলিশের গঠন করা তদন্ত কমিটির সঙ্গেও সমন্বয় করা হয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের জন্য করণীয় ও প্রতিকারের বেশ কিছু সুপারিশ তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশও (ডিএমপি) একটি তদন্ত কমিটি করেছে। এ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি সপ্তাহে পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি গুলশান বিভাগের তদন্ত প্রধান অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবদুল আহাদ। ইতোমধ্যে রোগীর স্বজন ও হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ২৫ জনের জবানবন্দি গ্রহণ করেছে এই কমিটি।
প্রসঙ্গত, ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আগুনে চিকিৎসাধীন ৫ জন রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় গত ২৭ মে রাতেই গুলশান থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় পরে নিহত ভারনন এ্যান্থনি পলের মেয়ের স্বামী রোনাল্ড মিকি গোমেজ বাদী হয়ে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে গত ৩ জুন গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলাও তদন্ত করছে পুলিশ। এদিকে অগ্নিকাণ্ডে চিকিৎসাধীন রোগীসহ ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রেদোয়ান আহমেদ রানজীব ও ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ হাইকোর্টে রিট করেছেন।