মাইক্রোবাসটি রূপনগর বেড়িবাঁধে ওঠার পরে প্রকৌশলী আনিছুর রহমান সেলিম ইশারা দেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের গলা চেপে ধরতে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি গলায় রশি পেঁচিয়ে টান দেই। তখন প্রকৌশলী সেলিমও দেলোয়ারকে চেপে ধরেন। দেহ নিস্তেজ হয়ে গেলে উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের খালি প্লটে রাস্তার পাশে লাশ ফেলে দেই, ফোনটি ফেলে দেওয়া হয় লেকে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর ভাড়াটে খুনি শাহীন এভাবেই পুলিশ ও আদালতে হত্যাকান্ডের বিবরণ দিয়েছে। হত্যায় জড়িত শাহীনের জবানিতে বেরিয়ে আসা আনিছুর রহমান সেলিমও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী। পুলিশ এরই মধ্যে তাকে ও হত্যায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাসের চালক হাবিবকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনজনকে আদালতে নিলে শাহীন ও হাবিব আদালতে জবানবন্দি দেয়। প্রকৌশলী সেলিমকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
গত ১১ মে বিকালে উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরের ফাঁকা প্লটের ঝোপ থেকে দেলোয়ারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই সকালে তিনি মিরপুরের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী খোদেজা বেগম তুরাগ থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যায় তিনজন গ্রেপ্তার হলেও কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলছে না। তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেলোয়ার হোসেন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। সিটি করপোরেশনে নিম্নমানের উন্নয়ন কাজ করায় তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারের অন্তত শতকোটি টাকার বিল আটকে দিয়েছিলেন। এ কারণেই শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। এ হত্যাকান্ডে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একজন জনপ্রতিনিধির যোগসাজশ থাকতে পারে বলেও তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র আভাস দিয়েছে।
অবশ্য গতকাল উত্তরা পূর্ব থানায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, তারা হত্যাকান্ডের মোটিভ এখনো উদ্ধার করতে পারেননি। তা উদ্ধারের জন্য তদন্ত চলছে। হত্যায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাস এবং নিহত দেলোয়ারের মোবাইল ফোনও ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিসি ফোনে বলেন, গ্রেপ্তার শাহীন ভাড়াটে কিলার, অপর আসামি হাবিব মাইক্রোবাস চালক। তারা ঘটনার কথা স্বীকার করেছে এবং বলেছে প্রকৌশলী সেলিম তাদের ভাড়া করেছে। হত্যাকান্ডের সময় ওই প্রকৌশলী গাড়িতেই ছিলেন এবং তার নির্দেশে হত্যাকান্ড হয়। এখন সেলিম কেন তার নির্বাহী প্রকৌশলীকে খুন করলেন, তার নেপথ্যে কেউ রয়েছে কিনা তা জানতে তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রযুক্তির সহায়তা এবং সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় প্রকৌশলী দেলোয়ারকে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার সময়ে একজন সাদা পিপিই পরা ছিলেন। পিপি পরা ব্যক্তি এক রিকশাচালকের ফোন থেকে দেলোয়ারকে ফোন দিয়ে বাসার বাইরে আসতে বলেন। পরে সেই রিকশাচালককে আটক করা হলে তিনি ১০০ টাকার বিনিময়ে সাদা পিপি পরা এক ব্যক্তি তার ফোনে কথা বলে বলে জানায়।
প্রকৌশলী সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম দাবি করেছিলেন ঘটনার দিন সকালে তিনি অসুস্থ থাকায় বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তিনি তার বাসার সঠিক ঠিকানা এড়িয়ে যান। একপর্যায়ে বাসার ঠিকানা দিলেও সেটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার আগে ও ঘটনার দিন আসামি সেলিমের অবস্থান করা বাড়িটির সন্ধান পাওয়া যায়। ওই বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার দিন সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে সাদা পিপিই ও কালো জুতা পরে সেলিম বের হচ্ছেন। প্রকৌশলী দেলোয়ারকে যেখান থেকে মাইক্রোবাসে তোলা হয়, সেখান থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজে থাকা দৃশ্যের সঙ্গে সেলিমের বাসার ফুটেজের মিল পাওয়া যায়। এরপর ওই আসামিকে এসব দৃশ্য দেখালে তিনি গাড়িতে থাকার কথা স্বীকার করেন। তবে কেন প্রকৌশলী দেলোয়ারকে খুন করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি তিনি।