প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে সকলকে কঠোর পরিশ্রম ও সততার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা সেবা প্রদান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারিগর- এ দুইয়ের সমম্বিত শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। দেশের সর্ববৃহৎ বাহিনী আনসার-ভিডিপি’র সদস্য হিসেবে আপনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন। জননিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে সততা, সাহস ও আন্তরিকতার সঙ্গে সবাইকে কাজ করতে হবে।
তিনি আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, মনে রাখবেন জনগণ ও বিনিয়োগের নিরাপত্তা এবং শান্তির পরিবেশ ধরে রাখা আপনাদের পবিত্র দায়িত্ব। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ। আপনারা এ পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমরা সবাই একযোগে কাজ করলে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলাদেশ’ অচিরেই বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারব- এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুরস্থ আনসার ও ভিডিপি একাডেমীতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৪০তম জাতীয় সমাবেশ উদ্বোধন অনুষ্ঠাণে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
এরআগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টা ৪৮ মিনিটে সফিপুর আনসার একাডেমির ইয়াদ আলী প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌছান। প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌছালে স্বরাষ্ট্র আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ তাঁকে স্বাগত জানান। এসময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আকম মোজাম্মেল হক এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, মেহের আফরোজ চুমকি এমপি, ইকবাল হোসেন সবুজ এমপি, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোঃ আনোয়ার হোসেন, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস.এম তরিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারসহ তিন বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী খোলা জীপে চড়ে প্যারেড পরিদর্শন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের কুচকাওয়াজ ও সালাম গ্রহণ করেন এবং ভাষণ দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ও জনস¤পৃক্ত একটি বৃহৎ শৃঙ্খলা বাহিনী। এ বাহিনীর কার্যক্রম তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ বাহিনীর সদস্য ৬১ লাখ। দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি গ্রামে বা মহল্লায় এ বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। সরকারের যেকোন সচেতনতামূলক কার্যক্রম আনসার- ভিডিপি’র সদস্যদের মাধ্যমে খুব সহজেই তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌছে দেওয়া সম্ভব। আমরা এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাহসিকতা ও কর্মদক্ষতা বর্তমানে সর্বজন স্বীকৃত। বাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার অঙ্গীভূত আনসার সদস্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। বিমান বন্দরের নিরাপত্তায় এ বাহিনীর সদস্যরা ‘এভসেক (এভিয়েশন সিকিউরিটি)’ এর অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। দেশ ও জনপদকে নিরাপদ রাখতে ২টি মহিলা ব্যাটালিয়নসহ এ বাহিনীতে ৪২টি আনসার ব্যাটালিয়ন রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় এ বাহিনীর ১৬টি ব্যাটালিয়ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে অপারেশনাল ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া নবগঠিত আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যরা কূটনৈতিক এলাকা, কূটনৈতিক ব্যক্তি এবং দেশের বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গঠনের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, জাতি সে স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে আমরা প্রবেশ করেছি। সম্প্রতি বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এসবই গত এগার বছরে আমাদের সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে সম্ভব হয়েছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে শান্তি, উন্নয়ন এবং দুর্যোগ মোকোবিলায় রোলে মডেল হিসেবে সমাদৃত। মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্রের হার আগের তুলনায় অনেক নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল নির্মাণ, কর্ণফুলী টানেল স্থাপন এ সবই আমাদের উন্নয়নের প্রতি অগ্রযাত্রার বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের যে কোন সমস্যা সমাধানে আমাদের সরকার সবসময় আন্তরিক ও সহানুভুতিশীল। এই বাহিনীর উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এবং তা অব্যহত আছে। আনসার বাহিনীকে ১৯৯৮ সালে সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় পতাকা প্রদান। ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক প্রদান। একটি গার্ড ব্যাটালিয়ান সহ ৪টি আনসার ব্যাটালিয়ন গঠন। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃৃতি কমপ্লেক্স ও আ¤্রকানন এর নিরাপত্তার জন্য দুটি আনসার ব্যাটালিয়ন গঠনের কার্যক্রম প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ব্যাটালিয়নের সাংগঠনিক কাঠামা পুনর্গঠন করে জনবলও বৃদ্ধি করা হয়েছে। আনসার ব্যাটালিয়ন আইন প্রণয়ন করার কার্যক্রম অব্যাহত। উপ-মহাপরিচালক থেকে মহাপরিচালক পর্যন্ত র্যাাঙ্ক ব্যাজ সমন্বয় করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ৬টি উপ-মহাপরিচালক এবং ১৭টি পরিচালক এর পদ সৃজন করা হয়েছে। বিগত বছরে বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদবীর ৯৬৬ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। আনসার ও ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। ঝুঁকি ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আপনাদের সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণের বিষয়টি সর্বদাই আমাদের সুদৃষ্টিতে রয়েছে। আপনাদের কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও দৃষ্টান্তমূলক দায়িত্বশীলতার স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিবছর সেবা ও সাহসিকতা পদক আমাদের সরকারই প্রবর্তন করেছে। আজ যারা সেবা ও সাহসিকতা পদক অর্জন করেছেন তাদের আমি জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এ বাহিনীর সদস্যগণ খেলাধুলা ও দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমস- এ বাংলাদেশের অর্জিত ১৪২টি পদকের মধ্যে ৬৮টি পদক অর্জন করেছে এ বাহিনীর খেলোয়াড়গণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ইংরেজি নববর্ষ বরণের সময়ে বিশৃঙ্খলা ও নাশকতা ঠেকাতে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আপনাদের বলিষ্ঠ ও সক্রিয় ভূমিকা দেশবাসী দেখেছে। বিভিন্ন সময়ে দেশের জননিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্বপালনকালে যেসব অকুতোভয় আনসার সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, আমি শ্রদ্ধাভরে তাদের স্মরণ করছি এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০২০-২০২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমি জানতে পেরেছি বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ‘মুজিব বর্ষের উদ্দীপন, আনসার ভিডিপি আছে সারাক্ষণ’ ¯ে¬াগানটিকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। এজন্য আমি এ বাহিনীর মহাপরিচালকসহ সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সদস্য-সদস্যাবৃন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা এ বাহিনীকে একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনারা সবসময়ই কর্মদক্ষতা ও সফলতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। বিশেষ করে জাতীয় সঙ্কটময় ও জরুরি মূহুর্তে আপনাদের কর্মতৎপরতা এ বাহিনীকে সরকারের এক নির্ভরযাগ্যে অংশে পরিণত করেছে। জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে দায়িত্বপালন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ ও মৌলবাদ নির্মূলে আপনাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আরো বলেন, আমি গভীরভাবে স্মরণ করছি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যাঁর মহান আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ পেয়েছি, পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। এ বাহিনীর গর্বিত সদস্য ভাষা শহিদ আনসার কমান্ডার আব্দুল জব্বার ১৯৫২ সালের ২১ এ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দেন। এ বাহিনীর ১২২৯ বীর সদস্য ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা মহান মুক্তিযুদ্ধে আনসার বাহিনীর ৬৭০ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রম হারা মা-বোনকে।
সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসিকতা ও সেবামূলক কাজে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ বীরত্বপূর্ন ও সেবামূলকসহ ৮টি ক্যাটাগরিতে আনসার ও ভিডিপি’র ১৪৩ জন সদস্যকে বাংলাদেশ আনসার পদক, প্রেসিডেন্ট আনসার পদক, বাংলাদেশ গ্রাম প্রতিরক্ষা দল পদক প্রদান করেন। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৪০তম জাতীয় সমাবেশের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সমাবেশ চলাকালে প্যারেড গ্রাউন্ডের দক্ষিণ পশ্চিম পার্শ্বে আনসার ও ভিডিপি’র সদস্য-সদস্যাদের মনোজ্ঞ ডিসপ্লে প্রদর্শণ করেন। পরে তিনি দরবারে যোগ দেন।
সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার একাডেমীর লেকের পাশে আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের অংশ গ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন ও কুটির শিল্প পরিদর্শণ করেন। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ-বাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের উর্ধতন কর্মকর্তাগণসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।