একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে নতুন প্রজন্মের মাঝে প্রজ্বলিত করতে পারে জ্ঞানের বহ্নিশিক্ষা। একুশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশে আজ শিক্ষা এগিয়ে চলছে। গ্রন্থগত তাত্বিক জ্ঞান অর্জন যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বাস্তবধর্মী প্রয়োগিক কলাকৌশল। শিক্ষা নতুন প্রজন্মকে অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার, অচেনাকে চেনার অদম্য স্পৃহায় উদ্দীপ্ত করছে, জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় বিস্ময়কর অবদান রাখছে। সরকারের নীতি-নির্ধারণ থেকে নীতি বাস্তবায়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। এমন যুগসন্ধিক্ষণে তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি অনেক বেশী অনুভূত হচ্ছে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং দায়িত্ব পরায়ণতার প্রবণতা এবং প্রয়োজনীয়তা।
একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনের প্রতিটি স্তরে দক্ষ মানব সম্পদের পাশাপাশি প্রয়োজন নৈতিকতার সুমহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ, অত্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ জনশক্তি, যারা জ্ঞানের জগতে যেমন হবেন উজ্জ্বল নক্ষত্র তেমনি ন্যায়পরায়ণতায় হবেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কখন, কীভাবে এ নৈতিকতার অবশ্যম্ভাবী জাগরণ করা সম্ভব? নৈতিকতার বীজ বপনের উপযুক্ত সময় একজন মানুষের শৈশবকাল। কিন্তু নৈতিকতায় কি ভাষার মত পারদর্শিতা অর্জন সম্ভব? নাকি গণিতের মত তীক্ষ্ম ক্ষুরধার সমীকরণ প্রয়োগ সম্ভব? কিংবা বিজ্ঞান শিক্ষার মত পরীক্ষা নির্ভর?
আসলে এমন প্রশ্নের সদুত্তর মেলা দুঃসাধ্য। তবে নৈতিকতার ব্যাপক বিস্তারে নৈতিকতা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু শুধু নৈতিকতার ও মূল্যবোধের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কতটুকু দায়িত্বনিষ্ঠ, সৎ, আদর্শ ও বিবেকবান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে তা নিঃসন্দেহে তর্কসাপেক্ষ। বিজ্ঞান শিক্ষায় ব্যবহারিক প্রয়োগিক পরীক্ষা ব্যতিরিকে তত্ত্বীয় জ্ঞানের সার্থকতা যেমন সামান্য, তেমনি নৈতিকতার ক্ষেত্রেও নিত্য নিয়িমিত সততা, মূল্যবোধ ও দায়িত্বনিষ্ঠার অনুশীলন ব্যতীত নৈতিকতার শিক্ষা বাস্তবে তাৎপর্যহীন। এমন পটভূমিতে কোমলমতি সবুজ প্রান শিশু-কিশোরদের বিশুদ্ধ মন, পরিশীলিত ভাবনা এবং নৈতিকতার একনিষ্ঠ অনুশীলনের একটি অবিস্মরণীয় প্রচেষ্টার নাম সততা স্টোর, যার উদ্ভাবক বাংলাদেশের দূর্নীতি দমন কমিশন।
দোকানদার বিহীন অভিনব এই দোকান স্থাপনের অভিযাত্রার সূচনা ২০১৬ সালে। নিত্যনৈমিত্তিক শিক্ষা উপকরণ, খাদ্য সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর সমাহারে এই নব দোকান থেকে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করছে এবং নির্ধারিত স্থানে নিজ দায়িত্বে মূল্য পরিশোধ করছে। আছে পণ্য, পণ্যতালিকা, ক্যাশবক্স, ক্রেতা, শুধু নেই বিক্রেতা। নেই অসদুপায় অবলম্বনের মানসিকতা। আর বিষয়টি সন্তোষজনক। এমন মননশীলতা ও বিবেকবোধের প্রতিনিয়ত অনুশীলন হচ্ছে প্রায় ৪০০০ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যেখানে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন তহবিল কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
এই উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিকী করণে দুদক আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে স্টোর প্রতি ৩০,০০০ টাকা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিক্ষা কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সমন্বিত উদ্যোগ এবং একাগ্র আন্তরিকতার নিপুণ ছোঁয়ায় উদ্যোগটি আজ সারাদেশে পথ প্রদর্শক জাগ্রত চেতনার বাতিঘরে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত নিজেকে সংযত রাখার প্রয়াস এবং সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বলা হয়ে থাকে, প্রথমে মানুষ অভ্যাস তৈরী করে, এরপর অভ্যাস মানুষকে তৈরী করে। আর সততা স্টোর কোমল প্রাণ শিক্ষার্থীদের মাঝে সৎ, সুন্দর, স্বচ্ছ ও পবিত্র মননশীলতার অনুশীলন করাচ্ছে যা ক্রমান্বয়ে অভ্যাসে রূপ নিলে এর সুফল নিশ্চয়ই মিলবে। তবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রতকরণে দূর্নীতি দমন কমিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসা উচিত। বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ১৩৭ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের নিজস্ব অর্থায়নে সততা স্টোর স্থাপিত হয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে এবং শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়সমুহের সততা স্টোরের সাফল্যের হার বেশী। তবে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ভুলবশত টাকা না দিয়েই দ্রব্যটি নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। এসেম্বলির সময় তাদেরকে অন্যান্য নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি সততা স্টোরের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। আবার শিক্ষার্থী-শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, এবং অভিভাবকদের সমন্বয়ে মতবিনিময় সভা করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। উপজেলা দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য এবং সুশীল সমাজের সদস্যগণও সময়ে সময়ে বিদ্যালয় পরিদর্শন পূর্বক শিক্ষার্থীদেরকে উপদেশ দিতে পারেন।
উদ্যোগটি দীর্ঘ মেয়াদে সক্রিয় রাখতে পারলে শিক্ষার্থীদের যে সততা ও বিবেকবোধের উদয় হবে তা চূড়ান্ত পরিণতিতে আদর্শ, মূল্যবোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেশ ও দশের সামগ্রিক কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করবে। এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।
মোঃ আরিফুল হক (রুবেল মাষ্টার)
পুঠিয়া, রাজশাহী।
মোঃ লিয়াকত আলী সেখ
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
শেরপুর, বগুড়া।