ইউনেস্কো বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন,২৯৮টি কর্মসূচির মাধ্যমে সারা বিশ্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করবে। এরমধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন নিঃসন্দেহে আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখার অনন্য সাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে ইউনেস্কো বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) বিকেলে একাদশ জাতীয় সংসদের ৬ষ্ঠ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারি দলের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ ও আব্দুস সালাম মুর্শেদীর পৃথক দুটি প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা একথা বলেন।
লিখিত প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী সংসদকে জানান, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ ও ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির অধীনে আটটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রস্তাবসমূহ যাচাই-বাছাইয়ের পর সারা বছর দেশে ও বিদেশে মুজিব বর্ষ উদযাপনের জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনায় জন্মশতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ, বঙ্গবন্ধুর নিজের রচনা, ভাষণ, অন্যান্য বিষয় ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা, দেশে ও বিদেশে সেমিনার, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বইমেলা ও অন্যান্য আয়োজন বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করার কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইউনেস্কো, জাতিসংঘ ও বিদেশে স্বনামধন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুর কর্মজীবন নিয়ে প্রচারণা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভাগ ও সংস্থা কর্তৃক উন্নয়ন ও সেবামূলক কার্যক্রম গ্রহণসহ অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বর্তমানে ২৯৮টি কর্মসূচি রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকারি ও বেসরকারি দফতর, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি হতে অসংখ্য প্রস্তাব পাওয়া গেলেও বাস্তবায়নের সুবিধার্থে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনায় ২৯৮টি কর্মসূচিতে সীমিত রাখা হয়েছে। আগামী ১৭ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বর্ণাঢ্য উৎসবমুখর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বছরব্যাপী কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে আগামী ১৭ মার্চ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিশেষ প্রার্থনা, জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন দফতর, সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও খণ্ডচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হবে। জাতীয় সংসদ সচিবালয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন আয়োজন করবে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জন্মশতবার্ষিকীর বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ‘জুলি ও কুরি’ পদক প্রাপ্তি দিবস উদযাপন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন পালন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন, বাংলা ও ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে। তিনি আরও বলেন, দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্যোগে তৃণমূলের জনগণকে সম্পৃক্ত করে মুজিব বর্ষ উদযাপন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা, ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি, স্কেচ ও আলোকচিত্র নিয়ে বই ‘শেখ মুজিব; লাইফ অ্যান্ড টাইমস’ প্রকাশ করা হবে। এছাড়া বিদেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত ভাষণ ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, ফরাসি, জার্মান, চাইনিজ, আরবি, ফারসি, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, কোরিয়ান ও জাপানি-এই ১২টি ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক ১০০টি গ্রন্থ প্রকাশনা। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দফতর, জেনেভা জাতিসংঘ দফতরের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা ও ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর চেয়ার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ, ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজে বঙ্গবন্ধুর সেন্টার স্থাপন, লন্ডনের মাদাম তুসো জাদুঘর এবং জাতিসংঘ সদর দফতরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও আদর্শ ভিত্তিক চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র প্রদর্শন, উইমেন পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড এবং মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও সকল ধর্মের অধিকার সুরক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হবে।
সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শস্য কর্মসূচিসহ বিজিবি, আনসার-ভিডিপি, পুলিশ ও র্যাবের নিজস্ব কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আগামী অমর একুশে বইমেলা বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করা হবে। ঢাকা লিট ফেস্ট কর্তৃক ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যাল বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করা হবে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২০ আয়োজন করা হবে। বঙ্গবন্ধু স্মরণে সারাদেশে এক কোটি বৃক্ষরোপণ করা হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবজারভেটরি স্থাপন করা হবে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বিমানের উড়োজাহাজ ও বিমানবন্দর সজ্জিত করবে। শিল্প মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প পুরস্কার প্রদান করবে।
তিনি আরও জানান, মিডিয়া, প্রচার ও ডকুমেন্টেশন উপ-কমিটি ১১টি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে সিএনএন, বিবিসি, আল-জাজিরা, স্কাই নিউজ চ্যানেল-২৪ ও এনডিটিভিতে কন্টাক্ট রিলিজ, আন্তর্জাতিকভাবে বহুল প্রচারিত প্রভাবশালী পত্রিকা, সাময়িকী ও ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ করা হবে। এছাড়া দেশের সকল জেলা ও থানায় ডিজিটাল স্ক্রিন স্থাপন করে প্রতিদিন নতুন নতুন কনটেন্ট সরবরাহ এবং বিদেশে বড় বড় শহরে ডিজিটাল স্ক্রিন স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। আর চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র কমিটি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর ১২টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর ২৪টি খন্ড ভিডিও চিত্র নির্মাণ, একটি ওয়েব সিরিজ নির্মাণ এবং মানব মুক্তির থিম নিয়ে ডিসেম্বর ২০২০ সালে একটি আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা হবে। আর ইংরেজি ও বাংলায় দুটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর পূর্ণদৈর্ঘ্য বায়োপিক চলচ্চিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
সরকার দলীয় সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ১৭ মার্চ হতে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কে মুজিব বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের শিল্প বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করবে।