গত ৫দিনে ঘরেত্তন (ঘর হতে) বারাই নাই (বের হই নাই) শীতেল্লাই (শীতের জন্য)। হামা (আমরা) নদীর হারে (ধারে) বেড়ীর পাসত (পাসে) থাই (থাকি)। গত ৫দিন কামে (কাজে) বেরই নাই। কামে ও নদীতে মাছ ধরতে না যাওয় (যাওয়ায়) এক বেলা রাদন লাগবো (রান্না করতে হবে)। আমগোরে কে দেখতে আইবো।
রবিবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়নের চর সিন্দুর্না এলাকার বাসিন্দা নসিমন বেওয়া। তীব্র শীতের জড়সড় হয়ে এ কথা গুলো বলছিলেন। পৌষের শুরুতেই লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। ঘন কুয়াশায় আর হিমেল হাওয়ায় কাঁপছে তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের মানুষ।
পশ্চিমে তিস্তা নদী আর উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ এরই মাঝে অবস্থিত লালমনিরহাট জেলা। হঠাৎ করেই কমতে শুরু করেছে তাপমাত্রা। শৈত্য প্রবাহে ঘন কুয়াশা ও প্রচন্ড ঠান্ডায় নাকাল হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীত জনিত বিভিন্ন রোগ-বালাই দেখা দিয়েছে । ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, বোরো’র বীজতলা, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের। চলতি শীতে তাপমাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
তিস্তাপারের বেশির ভাগ মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই শীতের তীব্রতা বাড়ায় গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় করছেন শীতার্তরা। তারা বেশি ভিড় করছেন ফুটপাতের পুরোনো কাপড়ের দোকানে। নিজেদের সাধ্যমত শীতের কাপড় কিনছেন শীতার্তরা। লালমনিরহাটে রবিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই এ পর্যন্ত এই জেলায় এই মৌসুমের সর্বনিন্ম তাপমাত্রা বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। লালমনিরহাট আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস সুত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটে গত ৫দিন ধরে ১০ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রায় উঠানামা করছে।
জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীতে জনজীবন বিপর্যাস্ত হয়ে পড়েছে। ৫দিনে রাতভর বেড়েছে শীতের ঠান্ডার তীব্রতা আর বৃষ্টির মত পড়ছে ঘন কুয়াশা। তীব্র শীতে সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছে ছিন্নমুল ও নিন্ম আয়ের মানুষ। সকাল গড়িয়ে মধ্য দুপুরেও মিলছেনা সূর্যের দেখা।
ঘন কৃয়াশার কারণে সকালে ১০ ফুট দুরেও কোন কিছু দেখা যাচ্ছেনা। সড়কে যানবাহন হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। এর পরেও বাড়ছে দূর্ঘটনা। শীতবস্ত্রের আশায় গরীব ছিন্নমূল মানুষ চেয়ে আছে।
গত বন্যায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি, বসতভিটা, আবাদি ফসল হয়েছে লণ্ডভণ্ড। ফসল বিনষ্ট হওয়ায় জেলায় অভাব অনাটন পৌছেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ফলে শীতের তীব্রতায় কাপড়ের অভাবে চরম বিপাকে পড়েছে জেলার ০৫ উপজেলার ছিন্নমুল, খেটে খাওয়া নদীভাঙ্গনের কবলে পড়ে ভিটেমাটি ও শয় সম্বলহীন লক্ষাধিক মানুষ।
বিশেষ করে হাতীবান্ধা উপজেলার চরাঞ্চলসহ খেটে খাওয়া শ্রমজীবিরা প্রচন্ড ঠান্ডায় মাঠে যেতে পারছেনা। ঠান্ডার কারনে স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও শিশুরা পরেছে চড়ম বিপাকে। জেলার নদনদী তীরবর্তী এলাকার চর ও দ্বীপ চরে বেশি করে ঠান্ডা অনুভুত হওয়ায় এখানকার মানুষজন খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। তীব্র শীতে দুর্ভোগ বেড়েছে গবাদি পশুপাখির। এদিকে শীতের তীব্রতায় হাসপাল গুলোতে ডাইরিয়া ও শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গত এক সপ্তাহে জেলার হাসপাতাল গুলোতে নিইমোনিয়া ও ডাইরিয়া রোগের কয়েকশত রোগী ছিল বলে হাসপালসুত্রে জানা গেছে। এদের মধ্যে শতাধিক শিশু।
এভাবে শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকলে শীত জনিত রোগে মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। সরকারি ভাবে শীতার্তদের মাঝে কিছু কম্বল বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল্য। তাও আবার দলীয় নেতাকর্মী, উপজেলা চেয়ারম্যান , ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারের মাঝে বিতরণ করা হয়। যার ফলে শীতবস্ত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্থানীয় জন প্রতিনিধির ভোট বিরোধী অধিকাংশ অসহায় মানুষ।
বিশেষ করে চরাঞ্চলের নদীভাঙ্গনের কবলে পড়া মানুষজন শীতবস্ত্র থেকে বেশি করে বঞ্চিত হয়েছেন। তাই আত্মঃ মানবতার সেবায় এগিয়ে এসে চরাঞ্চলের অসহায় শীতার্তদের মাঝে মোটা কাপড় বা বস্ত্র বিতরণে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছে এই অঞ্চলের অসহায় মানুষ, সাংবাদিক সমাজসহ সুধীজনেরা।
সিন্দুর্না ইউনিয়নের চর সিন্দুর্না এলাকার ১ নং ওয়ার্ড সদস্য মফিজার রহমান, ২ নং ওয়ার্ড সদস্য রমজান আলী ও ৩ নং ওয়ার্ড সদস্য আমিনুর রহমানের সাথে কথা বলে জানা যায়, চরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষজন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া দিনমজুর হওয়ায় তারা শীত নিবারণের জন্য শীত বস্ত কিনতে পারছেনা। পাচ্ছেনা কোন সরকারি / বেসরকারি শীতবস্ত্র।এছাড়াও চরাঞ্চল থেকে হাতীবান্ধা উপজেলা সহর প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার দুরে দুর্গম পথ হওয়া যেতে পারছেনা হাটবাজারে। ফলে তারা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সিন্দুর্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানান, তার ইউনিয়নের মধ্যে ৩টি ওয়ার্ডই চরাঞ্চল। সেখানে জনসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। প্রায় ৬-৭ শত পরিবারের বসবাস। তীব্র শীতে লোকজন খুবই কষ্টের মাঝে বসবাস করছে।চাহিদার তুলনায় সরকারি ববরাদ্দ অতি নগন্য থাকায় এখনও পর্যন্ত ওই এলাকায় সরকারি কম্বল পৌছাতে পারেননি। চরাঞ্চলের মানুষের দুঃখদুর্দশার লাগবে অতি দ্রুত সরকারি বেসরকারি শীতবস্ত্রের জন্য তিনি সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বর্তমানে লালমনিরহাটের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে পারে।
এদিকে শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে ঠান্ডাজনিত নানা রোগ। হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রমজান আলী জানান, ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। গত ৫ দিনের চেয়ে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, শীতার্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ শীতবস্ত্র রয়েছে। পাঁচটি উপজেলার নির্বাহী অফিসাররা শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ শুরু করেছেন।
প্রতিবারের ন্যায় এবারেও হাতীবান্ধা রিপোর্টার্স ক্লাবের সদস্যগন চরাঞ্চলের অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য শুরু করেছে শীতবসত্র সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম। আর শীতবস্ত্র বিতরণকারী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করার জন্য তারা দৃঢ় প্রতিশ্রতিবদ্ধ।
যোগাযোগ করুন সাধারণ সম্পাদক
রিপোর্টার্স ক্লাব হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট।
মোঃ ইউনুস আলী, লালমনিরহাট প্রতিনিধি