রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতার অভাব দেখতে পাচ্ছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, বেসরকারি অংশীজনদের তথ্য প্রদানে অনীহা আছে। তারা নিজেদের স্বচ্ছ বললেও তারা সেটা করছে না। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলোর দেয়া কর্মসূচি ব্যয়ের মধ্যে তাদের অনুদানে পরিচালিত এনজিওগুলোর পরিচালন ব্যয়ও অন্তর্ভূক্ত।এক গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার কাজে থাকা এনজিওগুলো নিজেদের পরিচালন ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। যে হিসাব তারা দেয়, প্রকৃত ব্যয় তার চেয়ে বেশি।বৃহস্পতিবার ঢাকায় টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলপূর্ব বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থান: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়‘ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
সেখানে বলা হয়, জাতিসংঘের যে সংস্থাগুলো কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে কাজ করছে, তাদের মধ্যে ইউএন উইম্যানের পরিচালন ব্যয় সবচেয়ে বেশি। যে টাকা তারা সেখানে খরচ করছে, তার ৩২ দশমিক ৬ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে পরিচালন বাবদে। বাকি ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ মানবিক সহায়তা কর্মসূচিতে খরচ করছে তারা।
টিআইবির প্রতিবেদন বলছে, জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে ইউনিসেফের পরিচালন ব্যয় সবচেয়ে কম, তাদের মোট ব্যয়ের ৩ শতাংশ। বাকি ৯৭ শতাংশ টাকাই তারা কর্মসূচিতে ব্যয় করে।
মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমনাভিযানের মুখে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছে।সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি এনজিও এ কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে।
কিন্তু কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ অর্থের একটি বড় অংশ বিলাসিতায় ব্যয় করছে বলে ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত মার্চে সাংবাদিকদের বলেন, বিদেশি এনজিওগুলো বরাদ্দের তিন চতুর্থাংশই বাংলাদেশে আসা তাদের কর্মীদের জন্য ব্যয় করছে। কেবল ছয় মাসেই এনজিও কর্মকর্তাদের হোটেল বিল বাবদ খরচ করা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। আর তাদের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়ায় ব্যয় হয়েছে আট কোটি টাকা।
টিআইবি বলছে, জাতিসংঘের অনুদানে পরিচালতি কর্মসূচির পরিচালন ব্যয়ের যে হিসাব সংস্থাগুলো দিয়েছে, তার প্রকৃত পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরও বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, বেসরকারি অংশীজনদের তথ্য প্রদানে অনীহা আছে। তারা নিজেদের স্বচ্ছ বললেও তারা সেটা করছে না। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থাগুলোর দেওয়া কর্মসূচি ব্যয়ের মধ্যে তাদের অনুদানে পরিচালিত এনজিওগুলোর পরিচালন ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয় বহন করতে পারবে কিনা- সেই প্রশ্নও এসেছে টিআইবির প্রতিবেদনে।
সেখানে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত প্রয়োজনের বিপরীতে সম্পূর্ণ অর্থ পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালে মানবিক সহায়তার তহবিলে বাংলাদেশ আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় মানবিক সহায়তা অনুদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে, ফলে খাতভিত্তিক বিভিন্ন সহায়তার অপ্রতুলতা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের ওপর আর্থিক ঝুঁকির আশংকা তৈরি করছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কমপক্ষে ২ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে রোহিঙ্গাদের পছেন। পরোক্ষ ব্যয় আরও অনেক বেশি। এছাড়াও রয়েছে আর্থ-সামাজিক, পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংকট।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার প্রসঙ্গ টেনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরেও যারা মিয়ানমারে এই নিধন প্রতিকারের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত। এখানে অনেকের স্বার্থ রয়েছে।আমরা সবসময় নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু এবারের এই সঙ্কট আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। জাতিসংঘের দপ্তরের কাছে প্রতিবেদন ছিল। তাদের স্পন্সর করা প্রতিবেদনে এই জাতিগত নিধন যে হতে পারে এবং প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
আর এখন স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তাকারীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার তার সামর্থ্য অনুযায়ী যতটা করার করছে। কিন্তু অপরপক্ষ মিয়ানমার বলশালী এবং তাদের পেছনে শক্তিশালী দেশগুলো রয়েছে। তারা কিছু রিলিফ নিয়ে ছবি প্রকাশ করে আর আমাদের সরকারকে আশ্বস্থ করে। আমি নামগুলো বলতেই পারি- ভারত, চীন ও জাপান।
রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে টিআইবি।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। জনবল ঘাটতির কারণে এনজিওগুলোর কার্যক্রমে তদারকি ব্যহত হচ্ছে।
কোথায় কী রকম দুর্নীতি হচ্ছে, তার একটি ধারণাও টিআইবির প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাই করতে ডিসি অফিসের সংশ্লিষ্ট কমিটিকে গাড়ি প্রতি আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।প্রকল্প শেষ হলে তার ছাড়পত্র পেতে ইএনও অফিসের কর্মকর্তাদের দিতে হয় ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এই কাজে ডিসি অফিসের সংশ্লিষ্টদের দিতে হয় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।
ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা বের হতে চাইলে দালাল ও টমটম ড্রাইভারদের ২৫০-৩০০ টাকা দিতে হয়।মানব পাচারের ক্ষেত্রে দালালদের প্রাথমিকভাবে ১০-২০ হাজার টাকা এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দেড় থেকে ২ লাখ টাকা দিতে হয়।রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীরাই এখন সংখ্যালঘু হয়ে গেছে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে মানসিক চাপের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলেও সতর্ক করা হয়েছে টিআইবির প্রতিবেদনে।
তারা মনে করছে, অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ও তা মোকাবেলায় পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়টি এখনও বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না।শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যয়সহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব নিরূপণ করে তা মোকাবেলায় কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।সেই সঙ্গে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে।