দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি বানভাসী মানুষের। ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন ও গৃহপালিত প্রাণী নিয়ে খাদ্য ও পানি সংকট, কর্মহীনতা, অসুস্থতাসহ নানা দুর্ভোগে রয়েছেন তারা। সরকারিভাবে যেটুকু সহযোগিতা করা হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়।
নীলফামারী: তিস্তায় পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকার বানভাসী মানুষের। ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন ও গৃহপালিত প্রাণী নিয়ে খাদ্য ও পানি সংকট, কর্মহীনতা, অসুস্থতাসহ নানা দুর্ভোগে রয়েছেন তারা। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) সকাল ৬টায় এখানে বিপদসীমার ৫২ দশমিক ৪৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশিদ এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
১৩ জুলাই বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এখানে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। ওইদিন তিস্তা পাড়ে হলুদ সংকেত জারি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সরেজমিন দেখা যায়, বানভাসীদের হাতে এখন কোনও কাজ নেই। আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে জলবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। এখনও কোনও কোনও পরিবার শুকনো খাবার খেয়ে দিনযাপন করছে। দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাদ্য সংকট। বিশদ্ধ পানীর (সুপেয়) অভাবে দেখা দিয়েছে নানা রোগবালাই। নেই চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
পূর্ব ছাতনাই কলোনি গ্রামের মহির উদ্দিন (৫৭) বলেন, উজানের পানি বাড়লে তিস্তার পানি বেড়ে যায়। নিমেষেই তলিয়ে যায় শত শত গ্রাম। রক্ষা করা যায় না বাস্তুভিটা, বাড়িঘর, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, জমির ফসল, বীজতলা ও শত শত একর আয়তনের পুকুরের মাছ।
একই গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪৯) বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে অনেক বাড়িঘর। সরকারিভাবে যেটুকু সহযোগিতা করা হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়।
এই এলাকার বন্যায় চরম কষ্টে দিনযাপন করছেন তিস্তাবেষ্টিত ডিমলার পূর্ব ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, গয়াবাড়ী, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী ও জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের বানভাসী মানুষরা।
উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, বানভাসী মানুষের বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি স্থাপন, শৌচাগার ও ফসলি জমির বীজ সরবরাহ একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
জেলা ত্রাণ, দুর্যোগ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এসএ হায়াত জানান, ডিমলায় ১৫০ মেট্রিকটন চাল, দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং জলঢাকা উপজেলায় ৪১ দশমিক ৪৬০ মেট্রিকটন চাল ও ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়।
সিভিল সার্জন ডা. রণজিৎ কুমার বর্মণ বলেন, পানিবাহিত ও বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য এই দুই উপজেলায় ২৪টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. আবুল কালাম আযাদ বলেন, জেলায় সাড়ে ৪৪ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ও সাড়ে ৬৭ হেক্টর জমির উঠতি শাক-সবজিসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরি জানান, বন্যায় পাঁচটি ব্রিজ, তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৪০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ও সাড়ে আট কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো দ্রুত সংস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ: চলতি বন্যা ও নদীভাঙনে গত দেড় সপ্তাহে সিরাজগঞ্জের প্রায় সোয়া তিন লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৩৪ জন। আংশিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন তিন লাখ ১৩ হাজার ১৭৭ জন। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) দুপুরের দিকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভার ৪০০টি গ্রাম সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৮২ হাজার ২৮১টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত তিন হাজার ২৮৩টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৯৯৮টি। বন্যার পানিতে পড়ে এবং পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েন চারজন।
ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা মোট ৫০ হাজার ৩১৮টি। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ছয় হাজার ৫০৫টি ও আংশিক ৪৩ হাজার ৮১৩টি। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৫ হাজার ৯৫৯ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে তিন হাজার ৪০০ হেক্টর জমির ধান, পাট ও শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ফসল।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী রণজিৎ কুমার সরকার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৩৩ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে হার্ডপয়েন্টে যমুনার পানি রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৯ মিটার (ডেঞ্জার লেভেল- ১৩ দশমিক ৩৫ মিটার)। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি বিপদসীমার নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. ফারুক আহম্মেদ বলেন, যমুনার পানি কমলেও বিপদসীমার ওপরেই রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে ৩৯৮ দশমিক ৩ টন জিআর চাল, পাঁচ লাখ নগদ টাকা ও তিন হাজার ২৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। মজুদ রয়েছে আরও ৫০১ মেট্টিক টন জিআর চাল, আট লাখ টাকা ও সাড়ে ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার। বানভাসিদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে ১১৫টি তাবু সরবরাহ করা হয়েছে। মজুদ রয়েছে ৩৮৫টি।
তিনি আরও বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে জেলা প্রশাসন। ত্রাণেরও কোনো সংকট নেই।
ফরিদপুর: পদ্মানদীর পানি কমতে শুরু করায় ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ফসলি জমি ও ঘরবাড়িসহ দুই একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
জানা যায়, প্রচন্ড স্রোত ও পানি কমতে থাকায় হঠাৎ করেই নদী তীর ভাঙতে শুরু করেছে। ঝুঁকির মুখে রয়েছে চরভদ্রাসনের বালিয়াডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বালিয়াডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা মনসুর মোল্যা জানান, গত বছর ভাঙনের পর আমার বাড়ি ছিল পদ্মার পাড়ে। কিন্তু এবার মনে হয় আর রক্ষা হবে না। সন্তানাদি নিয়ে আশ্রয় নেওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নেই। যেভাবে ভাঙন শুরু হইছে এভাবে চলতে থাকলে রাতটুকুও পার করতে পারবো না। এরআগেই আমার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেবে পদ্মা।
একই গ্রামের জলিল বিশ্বাস বলেন, পানি কমার সঙ্গে সঙ্গেই ভাঙন শুরু হইছে। থেমে থেমে ভাঙছে, কিন্তু ভাঙন যখন শুরু হয় তখন দুই তিন ঘণ্টা মধ্যে আর থামে না। জরুরি কোনো ব্যবস্থা না নিলে অনেক মানুষের ক্ষতি হয়ে যাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ জানান, চরভদ্রাসনে ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলো আমাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে বালিয়াডাঙ্গীতে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
লালমনিরহাট: উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ফের বন্যার পদধ্বনিতে শঙ্কিত লালমনিরহাটের তিস্তা পাড়ের হাজারো পরিবার।
সোমবার (২২ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় দেশের বৃহত্তম সেচপ্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটর। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০সে. মি.) বিপদসীমা বরাবরে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর আগে একই দিন সকাল ৯টা, দুপুর ১২টায় ও ৩টায় বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও তিন ঘণ্টা পরে তা বেড়ে গিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ফের বন্যার শঙ্কায় রয়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে প্রায় ২/৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব অঞ্চল গত ১০ জুলাই শুরু হওয়া সপ্তাহব্যাপী বন্যায় পানিবন্দি থেকে সবেমাত্র মুক্তি পেয়েছেন। বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই ফের বন্যার আশঙ্কায় আতংকিত হয়ে পড়েছেন তিস্তার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ।
তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর ও গোকুন্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ফের পানিবন্দি হতে শুরু করেছে এসব এলাকার নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী পরিবারগুলো। এসব অঞ্চলে বিগত বন্যায় শুরু হওয়া ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে রয়েছে বলে দাবি করেছে জেলা প্রশাসন।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তার চরাঞ্চল পাসাইটারী গ্রামের মানিক মিয়া ও মজমুল হক জানান, গত বন্যার পানি দুই দিন হলো নেমে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত শুরু করেছেন অনেকেই। এরই মধ্যে সোমবার দুপুর থেকে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিকেলে ফের পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন তারা। এখন ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। আরো বেড়ে গেলে রাতেই রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে ফের দুর্ভোগে পড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত তারা।
হাতীবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের চর হলদিবাড়ি গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, গত বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই সোমবার দুপুর থেকে ফের পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চরাঞ্চল। পানি যত বাড়ছে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ততই বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, উজানের পাহাড়ি ঢেউয়ে তিস্তার পানি প্রবাহ বেড়ে গিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। ব্যারেজ রক্ষার্থে সবগুলো জলকপাট খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে তিস্তার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে বলেও জানান তিনি।লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বিপদসীমা বরাবরে প্রবাহিত হচ্ছে। সার্বক্ষণিক তিস্তাপাড়ের মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। বিগত বন্যায় শুরু হওয়া ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম এসব এলাকায় চলছে। ফের বন্যা হলে মোকাবেলা করতে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে।