বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও কমেনি দুভোর্গ। নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছে বানভাসি মানুষ। তারা নৌকা দেখলেই ত্রানের আশায় ছুটে আসছেন। অনেক নারী পুরুষ আবার ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতেই দাড়িয়ে থাকছেন ত্রানের আশায়। অনেকেই জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে সংগ্রহ করছেন ত্রান সামগ্রী। এদিকে সরকারি ভাবে বরাদ্ধকৃত ত্রান চাহিদার চেয়ে কম বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলায় পদ্মা নদী ও আড়িয়ালখাঁ নদে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি ধীরগতিতে হ্রাস পেলেও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহে পানিতে ডুবে তিন শিশু এবং জামালপুরে পানিতে ডুবে ও সাপের ছোবলে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজবাড়ীতে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে খড়িয়া গ্রামের ১০টি পরিবারের ভিটেমাটি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায়ও চলছে পদ্মার ভাঙন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোথাও কোথাও ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা ছিল অপ্রতুল। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়নের একটি গ্রামে ত্রাণের চাল মাপে কম দেওয়ার প্রতিবাদ করায় ত্রাণ বিতরণকারী যুবলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন রাঙার নেতৃত্বে তাঁর লোকজনের পিটুনির শিকার হয়েছে ত্রাণ নিতে আসা বন্যার্ত নারীসহ সাতজন। কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

ফরিদপুর:ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলায় পদ্মা নদী ও আড়িয়ালখাঁ নদে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সদরপুরের চরমানাইর ইউনিয়নে আড়িয়ালখাঁ নদে ভাঙনও চলছে। গতকাল গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপত্সীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। চরভদ্রাসন উপজেলার চার ইউনিয়নের কয়েকশত পরিবার পানিবন্দি। এখানে ৪০টি পরিবারকে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে।

চরমানাইর ইউনিয়নের জাজিরা কান্দি ফাজিল মাদরাসা ভবনটি আড়িয়ালখাঁ নদের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।

গাইবান্ধা:গাইবান্ধায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি ধীরগতিতে হ্রাস পেলেও করতোয়া নদীর পানি এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ এলাকায় বাঙালী নদীর পানির তোড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে বন্যার পানিতে ডুবে গত তিন দিনে গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জ সুগার মিল এলাকায় মনু মিয়ার মেয়ে মুন্নি (৭) এবং সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের জাহেদুল ইসলামের মেয়ে জান্নাতী খাতুন (১০) মারা গেছে। এ নিয়ে জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

রেললাইনের ওপর দিয়ে পানিপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে গাইবান্ধার ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বোনারপাড়া জংশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল গত বুধবার থেকে চার দিন বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৪ হাজার ১০৪ জন আশ্রয় নিয়েছে। গাইবান্ধা পৌর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পৌর ও সদর উপজেলার বানভাসি মানুষের জন্য গতকাল শুকনো খাবার হিসেবে রুটি তৈরির কর্মসূচি উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি।

করতোয়া ও বাঙালি নদীর পানি বেড়ে প্রবল চাপে গাইবান্ধায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের তিনটি পয়েন্ট ধসে গেছে। এতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে গোবিন্দগঞ্জ পৌর এলাকাসহ অন্তত ৪০ গ্রাম। দুর্ভোগে পড়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ বানভাসি মানুষ। এদিকে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি ধীরগতিতে কমতে থাকলেও গাইবান্ধায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির তেমন কোনও উন্নতি হয়নি।

জানা গেছে,গত দুইদিন (শুক্রবার ও শনিবার) বিকাল পর্যন্ত গোবিন্দগঞ্জের চরবালুয়া, পশ্চিম কাজিপাড়াসহ তিনটি পয়েন্টে বাঁধের কিছু অংশ ধসে যায়। এর ফলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয় মহিমাগঞ্জ, কোচাশহর, শালমারা, তালুককানুপুর, নাকাইহাট, রাখালবুরুজ ও ফুলবাড়িসহ ৯টি ইউনিয়নে বিস্তীর্ণ জনপদ। ঘরবাড়ি তলিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।এছাড়া পৌর এলাকার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসাবাড়ি, অলিতেগলিতে এখন হাঁটু পানি। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার আখসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। ভেসে গেছে প্রায় শতাধিক পুকুর ও খামারের মাছ। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কয়েকটি সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থাও।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান জানান, বাঁধ ধসে উপজেলার ৮-৯টি ইউনিয়নের অন্তত ৪০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৩৫ মে. টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বরাদ্দের চাল বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এনডিসি) সাহিদুল ইসলাম বলেন, গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সাদুল্যাপুর, পলাশবাড়ীর আংশিক ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার অর্ধশতাধিক ইউনিয়নসহ দুই পৌর এলাকায় পানিবন্দি হয়েছেন সাড়ে চার লাখ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার বাড়িঘর। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে কাঁচা-পাকা রাস্তা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁধ।তিনি আরও বলেন, ‘বিস্তীর্ণ এলাকার বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ৯ হাজার ৮২১ হেক্টর। এছাড়া ২ হাজার ৯৪১ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। পানি ওঠায় ও ধসে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে পড়েছে জেলা ও উপজেলাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এছাড়া পানির প্রবল চাপে রেললাইনের স্লিপার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্ধ রয়েছে ট্রেন যোগাযোগ।

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন বলেন, ‘দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য প্রতিদিন ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে এক হাজার মেট্রিক টন চাল, নগদ সাড়ে ১০ লাখ টাকা ও পাঁচ হাজার কার্টন শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তবে লোকবল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দুর্গম চরাঞ্চলসহ দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, বন্যা কবলিত মানুষের জন্য ১৬৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রয় নিয়েছে ৭১ হাজার ২৪ জন। অধিকাংশ কেন্দ্রেই পৌঁছানো হয়েছে চাল ও শুকনো খাবারের প্যাকেট। দুর্গত মানুষের জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় ৭৫টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।

অপরদিকে, গত পাঁচ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে মারা গেছে তিন শিশুসহ পাঁচজন। পাঠদানসহ সার্বিক কার্যাক্রম বন্ধ রয়েছে প্রায় চার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

রোববার (২১ জুলাই) সকালে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সকাল ৮টা পর্যন্ত ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১১ সে.মি কমে বিপদসীমার ১৩২ সে.মি, ঘাঘট নদীর পানি ১৩ সে.মি কমে শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৪ সে. মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া করতোয়া ও বাঙালি নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার ৭ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৫০ সে. মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর দুইদিন পরেই সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমে আসবে।

জামালপুর :বকশীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও কমেনি দুভোর্গ। নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছে বানভাসি মানুষ। তারা নৌকা দেখলেই ত্রানের আশায় ছুটে আসছেন। অনেক নারী পুরুষ আবার ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতেই দাড়িয়ে থাকছেন ত্রানের আশায়। অনেকেই জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে সংগ্রহ করছেন ত্রান সামগ্রী। এদিকে সরকারি ভাবে বরাদ্ধকৃত ত্রান চাহিদার চেয়ে কম বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

জানাগেছে,গত সাত দিনের ভয়াবহ বন্যায় বকশীগঞ্জ পৌরসভাসহ উপজেলার মেরুচর, সাধুরপাড়া, নিলাক্ষীয়া,কামালপুর,বাট্টাজোড় ও বগারচর ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্ধি হয়ে পড়েছে। বসতভিটা, ফসলি জমি, বাজারঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে কমপক্ষে শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি। তাই বসতবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন তারা। রাস্তা ঘাট-ব্রীজ কালভার্ট ভেঙ্গে যাওয়ায় এবং বেশিরভাগ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি,খাবার স্যালাইন ও শুকনা খাবারের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাচ্ছে বানভাসি মানুষ। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে তিল ধারনের ঠাই নেই। তাই বাধ্য হয়ে উচু সড়কে খোলা আকাশের নিচে ঠাই নিয়েছে হাজারো বানভাসী পরিবার। ফলে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বানভাসী মানুষ। তাই নৌকা দেখলেই বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে ত্রান পাওয়ার আশায় ঝাপিয়ে পড়ছে অথই পানিতে।

এ ব্যাপারে বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হাসান মাহবুব খান জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৭৫ মে.টন চাল,১৯১ কার্টুন শুকনো খাবার ও নগদ ১ লাখ টাকা ৪০ হাজার টাকা বরাদ্ধ পাওয়া গেছে। যা বানভাসীদের মাঝে বিতরন অব্যহত আছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন,যতক্ষন বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ ঘুরে দাড়াতে না পারবে ততক্ষন সরকার তাদের পাশে থাকবে। সরকারের নির্দেশ মোতাবেক প্রশাসনও তাদের পাশে থাকবে।