অতি ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সুরমা ছাড়া দেশের সকল প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বর্তমানে পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে লাখ লাখ মানুষ।

বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। লোকজন আশ্রয় নিতে শুরু করেছে পার্শ্ববর্তী উঁচু বাঁধ, পাকা সড়ক ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব এলাকার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ৯৩টি পানি সমতল স্টেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, সোমেশ্বরী, কংস, ধরলা, তিস্তা, ঘাগট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী এই ১৪টি নদীর পানি ২৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ৭৩টি পয়েন্টে বৃদ্ধি ও ১৮টি পয়েণ্টে হ্রাস পেয়েছে। শনিবার ১৫টি নদীর ২৩টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম ও মেঘালয় প্রদেশসমূহের বিস্তৃত এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টায় মাঝারী থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সংলগ্ন ভারতের বিহার এবং নেপালে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

নদ-নদীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আজ জানানো হয়েছে, পানি পরিস্থিতি ১টি পয়েন্টে অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ১টি পয়েন্টের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৭২ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, পদ্মা ও যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে এবং আগামী ২৪ ঘন্টায় যমুনা নদী সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

আগামী ২৪ ঘন্টায় সিলেট ও রংপুর বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ধরলাসহ প্রধান নদীসমূহের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ছাড়া আগামী ২৪ ঘন্টায় নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
গতকাল সকাল ৯টা থেকে গত ২৪ ঘন্টায় পঞ্চগড় স্টেশন এলাকায় ২০০ মিলিমিটার, ডালিয়ায় ১৭৭ মিলিমিটার, রাঙ্গামাটিতে ১২৫ মিলিমিটার, টাঙ্গাইলে ১২২ মিলিমিটার, মহেশখোলায় ১৯০ মিলিমিটার, নরসিংদীতে ২০৮ মিলিমিটার, ঢাকায় ১০২ মিলিমিটার, শ্রীমঙ্গলে ২৫০ মিলিমিটার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪৫ মিলিমিটার এবং কুমিল্লায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।এদিকে বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর ৯৫১৫৫৫১। এই কন্ট্রোল রুম সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।

বন্যা পূনর্বাসনে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বন্যা উপদ্রত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে এবং বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ে মেডিকেল টিম এবং জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ত্রাণ কার্যক্রম তদারকি করা হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম: তিনদিন ধরে বানের পানিতে ভাসতেছি। বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। নৌকার ওপর কোনো রকমে দিন-রাত পার করতেছি। চারপাশেই বানের পানি। চুলায় রান্না করে খাওয়ারও কোনো উপায় নাই। নৌকায় করে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে কিছু চাল আর আলু সিদ্ধ করে আনছি। তা দিয়েই আজ দুপুরে খেয়েছি। বাকি যা আছে তা কাল সকালে খাবো।

রোববার (১৪ জুলাই) দুপুরে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ধরলা অববাহিকার চর বড়াইবাড়ি গ্রামের মজিয়া খাতুন (৫০) নামে এক নারী নিজের বাড়ির উঠোনে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে এভাবেই বন্যা দুর্ভোগের কথাগুলো বলছিলেন।তিনি বলেন, যেভাবে পানি বাড়ছে, এতে বাড়িতে থাকা দায় হয়ে গেছে। পানির স্রোতে যদি আমাদের ঘরবাড়ি ভেসে যায়, তাহলে আমরা কোথায় যাবো? কোথায় আশ্রয় নেবো? আল্লাহ জানেন!

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, রোববার বিকেল পর্যন্ত কুড়িগ্রামের সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার, চিলমারি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপরে ছিলো।

সরকারি হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলার নয়টি উপজেলার নদ-নদী অববাহিকার চর-দ্বীপচর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বর্তমানে পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে কমপক্ষে ৫২ হাজার ৫২০টি পরিবারের প্রায় দুই লাখেরও বেশি মানুষ। এছাড়া বন্যার পাশাপাশি নদী ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়েছে এক হাজার ৩১টি পরিবার। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। লোকজন আশ্রয় নিতে শুরু করেছে পার্শ্ববর্তী উঁচু বাঁধ, পাকা সড়ক ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব এলাকার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

নদ-নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের পানিবন্দি কিছু পরিবার নৌকার অভাবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু জায়গায় যেতে পারছেন না। অনেক পরিবারই অন্যের নৌকা ধার নিয়ে উঁচু স্থানে আসতে শুরু করেছেন। এছাড়া চরাঞ্চলগুলোতে শুকনো জায়গা না থাকায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার অনেক মানুষ।

কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হাফিজুর রহমান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় আমরা পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর জন্য ২৮০ মেট্রিক টন চাল, দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও নগদ ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এগুলো বন্যাকবলিত এলাকায় বিতরণ শুরু হয়েছে। এছাড়াও ২২০ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মজুদ রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে আরও এক হাজার মেট্রিক টন জিআর চাল, ২০ লাখ টাকা এবং ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। রোববার দুপুর পর্যন্ত শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেলার ৮ উপজেলায়ই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪ হাজারে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফরিদুল হক জানিয়েছেন, সরকারি উদ্যোগে ১০ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হলেও দুর্গতরা আশ্রয় কেন্দ্রে আসছেন না। তবে দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এই পর্যন্ত বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ৫০০ টন চাল, সাড়ে ১০ লাখ টাকা এবং ৫ হাজার ২৩৫ প্যাকেট শুকনো খাবার এসে পৌঁছেছে।

সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, বন্যায় সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। ত্রাণসামগ্রী যা প্রয়োজন তা দেয়া হবে।

হবিগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, জেলায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। হাওরেও বৃদ্ধি পাচ্ছে পানি। কুশিয়ার নদীর পানি বৃদ্ধিতে নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জের অন্তত ৫০ গ্রামের মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন।হবিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক ও রাজস্ব) তারেক মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, নবীগঞ্জ উপজেলার দীগলবাক ও ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ১০ টন চাল বরাদ্ধ করা হয়েছে। খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম: খাগড়াছড়ি জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। আজ সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও ভারী বর্ষণ হয়নি। খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও পানছড়ি উপজেলার নি¤œাঞ্চল থেকে পানি সরে যাওয়ায় লোকজন বসতবাড়িতে ফিরে গেছেন।

খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. হাবিব উল্লাহ জানান, খাগড়াছড়ির সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। যে কোন ধরণের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে জেলা প্রশাসন। পানিবন্দি মানুষের সাহায্যার্থে রান্না করা খাবারের পাশাপাশি ৫০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলার বন্যাদুর্গতদের জন্য ৮০ টন চাল বরাদ্দ করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। চলছে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ে ১৭টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৮টিতে লোকজন আছেন। ফেনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রামগড়ে শনিবার নতুন একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ওই কেন্দ্রে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

কক্সবাজার: টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার একটি পৌরসভা ও ২৫টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন দুই উপজেলার অন্তত চার লাখ মানুষ।এসব এলাকায় খাদ্য ও খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে ব্রিজ-কালভার্ট ও বেড়িবাঁধ। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারী বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদী বেয়ে পার্বত্য এলাকা থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় পানির তোড়ে চকরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিএমচর ইউনিয়নের বেতুয়া বাজার ব্রিজের অ্যাপ্রোচ সড়কের মাটি সরে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে ব্রিজটি। গত তিনদিনে উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি বসতঘর নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

জানা গেছে, গত শুক্রবার থেকে চকরিয়া, পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা ও আলীকদমে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এই বৃষ্টির পানি রাতের দিকে মাতামুহুরী নদী দিয়ে নেমে আসে ভাটির দিকে। এ সময় নদীর দু’কূল উপচে লামা-আলীকদম প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি চকরিয়ার পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৮০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, সাহারবিল, চিরিংগা, কৈয়ারবিল, কোণাখালী, বিএমচর, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, ফাঁসিয়াখালী ও পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত উপজেলার তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমান ও সুরাজপুর-মানিকপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক ও লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার জানান, বন্যার কারণে এসব ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা জানান, ঘরের ভেতরে পানি ঢুকে যাওয়ায় রান্না করতে না পারায় পানিবন্দি পরিবারগুলোতে খাদ্য ও খাবার পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। তবে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানান তারা।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৪০ মেট্রিক টন জিআর চাল এবং আমার ব্যক্তিগত তরফ থেকে ১০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ চলমান রয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে ক্ষয়-ক্ষতির নিরূপণ করে করণীয় ঠিক করা হবে।

পেকুয়ায় একলাখ মানুষ পানিবন্দি- একই কারণে পেকুয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের চার হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় অসহায় জীবনযাপন করছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন বানভাসি মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে শীলখালী ও পেকুয়া সদর ইউনিয়নের শতভাগ পরিবার প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও উজানটিয়া, মগনামা, বারবাকিয়া, টইটং, রাজাখালী ইউনিয়নে আংশিক প্লাবিত হয়েছে। সব মিলে এ উপজেলায় প্রায় পাঁচশ’ বাড়ি-ঘর পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহাবুব-উল করিম বলেন, বৃষ্টি না কমায় উপজেলায় বন্যা অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে মেহেরনামার ঢলের পানিতে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধটি সংস্কার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া ২০ মেট্রিক টন চাল ও পাঁচশ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

ভোলা: ভোলায় মেঘনার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার তিন উপজেলায় প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৩৫টি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ।

পানিতে তলিয়ে গেছে বসত-ভিটা, ফসলি জমি ও রাস্তা-ঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষ। পাহাড়ি ঢল ও পূর্ণিমায় সৃষ্ট জোয়ারের চাপে এসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।পাউবো জানায়, রোববার (১৪ জুলাই) মেঘনার পানি বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার বাঁধের বাইরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

পাউবো ডিভিশন-২ নির্বাহী প্রকৌশলী কাওছার আলম বলেন, মনপুরা উপজেলার মনপুরা, হাজিরহাট, উত্তর ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম, তজুমদ্দিন উপজেলার সোনাপুর, চাচড়া ও সাদপুর ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম ও চরফ্যাশনের মাদ্রাজ ও আসলামপুর ইউনিয়নের চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তবে বাঁধের বাইরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হলেও বাঁধের ভেতরে কোথাও পানি ওঠেনি।

তিনি আরও বলেন, জোয়ারের পানির তীব্রতার কারণে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তিন উপজেলার ২৬ কিলোমিটার বাঁধ। ঝুঁকিপূর্ণ কিছু এলাকায় বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।এদিকে, জোয়ারের পানিতে ঢালচর, কুকরী-মুকরী ও চরপাতিলাসহ বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হওয়ার তথ্য জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

অপরদিকে, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ইলিশা ফেরি ও লঞ্চঘাট। পানিতে ঘাটের র‌্যাম (ফেরিতে ওঠা-নামার পথ) ও গ্যাংওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় ফেরিতে ওঠা-নামা করতে পারছেনা কোনো যানবাহন।

ফেরির ঘাট সহকারী হেলাল উদ্দিন বলেন,জোয়ারের পানিতে ঘাট প্লাবিত হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজটের। শিগগিরই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।

সিরাজগঞ্জ: প্রায় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে নদীর অভ্যন্তরের চরাঞ্চলগুলো একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে অরক্ষিত নদী তীর এলাকায়। এদিকে গত তিনদিন ধরে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চলের শত শত একর ফসলি জমি। ডুবতে শুরু করেছে এসব অঞ্চলের বাড়ি-ঘর। পানি বৃদ্ধির তীব্রতায় ভয়াবহ বন্যা আতঙ্কে রয়েছে নদী তীরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দারা।

রোববার (১৪ জুলাই) সকালে যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১৩.১৫ মিটার রেকর্ড করা হয়েছে। যা বিপদসীমার মাত্র ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (ডেঞ্জার লেভেল-১৩.৩৫)। গত তিনদিনে যথাক্রমে ৩০, ৪০ ও ৩৩ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ ও কাওয়াকোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম ভূঁইয়া বলেন, গত কয়েকদিন ধরে দ্রুতগতিতে বাড়ছে পানি। ইতোমধ্যেই চরাঞ্চলের ফসলি জমিগুলো সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। নিচু বাড়িগুলোতেও পানি উঠেতে শুরু করেছে। অপরদিকে শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুল্লুক চান জানিয়েছেন, এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণগাঁতী, আড়কান্দি ও হাটপাচিল নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বেশ কয়েকদিন ধরেই ভাঙন দেখা দিয়েছে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন উপ-সহকারী প্রকৌশলী রনজিত কুমার সরকার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ৩৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচে (১৩.১৫ মিটার) দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত তিন দিনে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে পানি। আরও দু’একদিন বাড়তে পারে।