ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে হাজেরা বেগম (৮০) নামে এক বৃদ্ধা মাকে মারধর করে খোলা আকাশের নীচে ফেলে রেখে গিয়েছিল পাষণ্ড ছেলেরা। অবশেষে পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে গফরগাঁওয়ের সেই বৃদ্ধা মায়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে ঘরে নিয়েছেন তিন সন্তান। আর কোনোদিন মায়ের সাথে অন্যায় আচরণ করবে না মর্মে লিখিত দিয়ে রাতেই বাসায় নিয়ে গেছেন তারা। সোমবার (২৭ মে) রাতে গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল আহাদ খানের কার্যালয়ে প্রাণবন্ত ও আবেগঘন এ ঘটনা ঘটে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন গফরগাঁও সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী, গফরগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল আহাদ খান, ইউপি চেয়ারম্যান শামছুল আলম খোকন, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন রিপন, আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেমসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
পরে থানা পুলিশের পক্ষ থেকে হাজেরা বেগমকে নতুন শাড়ি, সেমাই-চিনি, তেল-সাবানসহ ঈদ সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। গফরগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল আহাদ খান বলেন, ভালো লাগছে যে হাজেরা বেগমের ছেলেরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রত্যেক ছেলে এক মাস করে মায়ের ভরণপোষণ করবে-ছেলেদের কাছ থেকে এমন একটি মুচলেকা রাখা হয়েছে। এর অন্যথা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গফরগাঁও সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করা ছেলে-মেয়ের দায়িত্ব আর বাবা-মায়ের অধিকার। হাজেরা বেগমের প্রতি থানা পুলিশের নজর থাকবে। তার অমর্যাদা হলেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, বছর দুয়েক আগে ওই বৃদ্ধার ৩ ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে সাইফুল কৌশলে মায়ের ১২ কাঠা জমি লিখে নেন। এরপর থেকে অপর দুই ছেলে ৮০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি অসদাচরণ শুরু করেন। গত বৃহস্পতিবার ছোট ছেলে সাইফুল তার মাকে মারধর করে বাড়ির সামনের সড়কের পাশে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখে আসে। ৩ দিন সেখানে পড়ে থাকার পর বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
পরে শনিবার রাতে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস সোবহান ও কালা মিয়া প্রতিবেশীদের সহায়তায় বৃদ্ধা হাজেরা বেগমকে উদ্ধার করে গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। এ ব্যাপারে ওই ইউপি সদস্য বৃদ্ধার ছেলে ও নাতিদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেন।
পুলিশ ও এলাকাবাসী অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার উথুরী গ্রামের মৃত রেসমত আলীর স্ত্রী হাজেরা বেগমের তিন ছেলে-সাইফুল ইসলাম (৪০), সোহরাব উদ্দিন (৪৫) ও আব্দুস সাত্তার (৫০)। প্রায় ১৬ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার সময় হাজেরা বেগমের নামে ১২ কাঠা জমি লিখে দেন। স্বামী মৃত্যুর পর ছেলেরা হাজেরা বেগমকে কিছুদিন ভরণপোষণ দেন। এক পর্যায়ে ছোট ছেলে সাইফুল ইসলাম গোপনে বৃদ্ধ মায়ের কাছ থেকে ১২ কাঠা জমি নিজের নামে লিখে নেন। এ খবর পাওয়ার পর অন্য ছেলেরা মায়ের ভরণপোষণ ও খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দেন।
এই পরিস্থিতিতে হাজেরা বেগম ছোট ছেলে সাইফুলের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন। তবে কিছুদিন পর সাইফুলও তার মাকে ভাত কাপড়ের কষ্ট দিতে থাকেন। তিনবেলার মধ্যে কখনো একবেলা, আবার কোনো কোনোদিন খাবারই দেয়া হতো না হাজেরা বেগমকে। খাবার চাইলে উল্টো মাকে মারধর করতো সাইফুল।
এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে একাধিকবার বিচার সালিশও হয়েছে। কিন্তু মায়ের জমি লিখে নেয়ায় বিচার সালিশে সাইফুলকেই তার মা হাজেরা বেগমের ভরণপোষণের দায়িত্ব দেন সালিশকারীরা। তবে সাইফুল বিচার সালিশ না মেনে বৃহস্পতিবার সকালে মাকে মারধর করে বাড়ির সামনে সড়কের পাশে ফেলে আসেন। পরে গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আহাদ খান বলেন, ছেলেদের হাতে ৮০ বছরের বৃদ্ধা মা এমন নির্যাতিত হবেন বিষয়টি ভাবতেও কষ্ট হয়। হাসপাতালে গিয়ে দুখী ওই বৃদ্ধার খোঁজ নিয়েছি। পাশাপাশি বৃদ্ধার এক ছেলেসহ দু’জনকে আটক করা হয়েছে।