ফেনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রয়েছে তিন শতাধিক অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম। অমুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের মত সম্মানী ভাতা উত্তোলন করছেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা। ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সম্মানী ভাতার তালিকা থেকে অন্তর্ভূক্তদের বাদ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী ও জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন তারা। সাম্প্রতিক গেজেট বাতিল হওয়ার তালিকায় রয়েছেন আয়কর কর্মকর্তা ছাগলনাইয়া উপজেলার আ জা মু জিয়াউল হক। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকুরি পেয়েছিলেন। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এক বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে চাকুরি করছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হবে।

ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও কমান্ডাররা জানায়, ফেনী জেলার ৬ উপজেলায় ২ হাজারেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানী ভাতা দেয়া হচ্ছে। ওই মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদানের তালিকায় ৩শ জনেরও বেশী অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে দাবী করেছেন ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আবদুল হান্নান। মুক্তিযোদ্ধা অফিসের কতিপয় লোকজনের যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে ভুয়া ও জাল কাগজপত্র তৈরী করে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করে ভুয়া সনদ প্রদান করে। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তালিকা বাদ দেয়ার জন্য একাধিক মানববন্ধন করেছেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। আবদুল আউয়ালসহ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নামে প্রকাশিত গেজেটসহ সকল সুযোগ সুবিধা বাদ দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিকট লিখিতভাবে আবেদন করেন ফেনী জেলা ইউনিট কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার মাষ্টার মো. শাহজাহান। এর মধ্যে অমুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শর্শদি ইউনিয়নের রাস্তারখিল গ্রামের মৃত সিদ্দিক আহমদের ছেলে আবদুল আউয়াল, কালিদহ ইউনিয়নের মাইজবাড়ীয়া গ্রামের মৃত উজির আলী মিয়ার ছেলে সিপাহী নুর করিম, সদর উপজেলার ফাজিলপুর গ্রামের শিবপুরের মৃত নাজির আহাম্মদের ছেলে রফিকুল হক, একই এলাকার মৃত আবদুল বারিক চৌধুরীর ছেলে আবুল কালাম (কাশেম), মকবুল আহমদের ছেলে আবুল খায়ের, আসলাম হোসেন ভূঞার ছেলে আমির হোসেন ভূঞা।

সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মৃত আবদুল ওয়াদুদের ছেলে শাহ আলম, লেমুয়া ইউনিয়নের মীরগঞ্জ গ্রামের মৃত মুসলিম মিয়ার ছেলে মমিনুল হক। ডেপুটি কমান্ডার মো. শাহজাহান মাষ্টার জানান, এ ৮ জনসহ সকল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাময়িক সনদ ও গেজেটসহ সকল সুযোগ সুবিধা বাতিলের জন্য মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মর্যাদা হারাচ্ছেন। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নে ৯ জন অমুক্তিযোদ্ধাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ও তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের প্রতি আবেদন করেন শর্শদি ইউনিয়ন কমান্ডার ডা. বদিউর জামান। শর্শদি ইউনিয়নের অমুক্তিযোদ্ধা হলেন- আবদুল আউয়াল, নোয়াবাদ গ্রামের আলহাজ্ব সোলতান আহমদের ছেলে মোস্তফা কামাল উদ্দীন আল আজাদ, ঘাগরা গ্রামের সেকান্দার আলীর ছেলে আবদুল মালেক, একই গ্রামের মৃত বারীক আমিনের ছেলে ল্যা. না. সহ-নুরুল হুদা ও আবদুল হাকিমের ছেলে মৃত কবির আহাম্মদ ভূঁঞা ও সফিয়াবাদ গ্রামের বজলুর রহমানের ছেলে নায়েক সুবেদার আবদুল গফুর।

শহীদ মকবুল আহমদের ছেলে আবদুল মালেক জানান, রাস্তারখিল গ্রামে, রাজাঝির দিঘীর পাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। আবদুল আউয়াল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে। নিজ গ্রামের মৃত হাজী রুস্তম মিয়ার ছেলে মকবুল আহমেদ, মৃত আবদুস সোবহানের ছেলে আবদুল মালেক, মৃত শরাফত আলীর ছেলে আবদুল কাদের, মৃত কালা মিয়ার ছেলে নাবালক মিয়া ও মৃত নাজির আলীর ছেলে আবদুল কুদ্দুস। এ ৫ জনকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়। পরে তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করেও তাদের লাশ পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাকারী আবদুল আউয়াল স্বাধীনের পর দেশ থেকে পালিয়ে যায়। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর শর্শদি ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গোলাম কিবরিয়ার পা ধরে প্রাণভিক্ষা চান আবদুল আউয়াল। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলে কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০২ সালে আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের অস্থায়ী বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ পান। ২০০৩ সালে স্থায়ী বিচারপতি হন। ২০১৩ সালে ১৩ আগস্ট তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর ২০১৩ সালে ৩ অক্টোবর বেসামরিক গেজেটে (অতিরিক্ত গেজেট) মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আবদুল আউয়াল নাম প্রকাশ হয়। একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সাময়িক সনদপত্র লাভ করেন।

তিনি আরো জানান, মুক্তি বার্তা ও লাল বইসহ বিভিন্ন তালিকায় কোন সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেছেন তার নাম নাই। রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধা আবদুল আউয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা কমান্ডার কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছেন। তার মা খায়েরের নেসা বাদী হয়ে আবদুল আউয়ালসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২ মার্চ ফেনী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করেন।

তৎকালীন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী মামলাটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এসআই মো. আনিসুর রহমান ১৬ মার্চ তদন্ত করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আমাদের এ মামলাটিসহ অন্যান্য মামলা তদন্ত করতে ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ফেনীতে অবস্থান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হরি দেবনাথ। ২০১৭ সালের ১৫ মে ফেনীতে আসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কো-অর্ডিনেটর মুহ. আবদুল হান্নান খান পিপিএম। তিনি শর্শদি ইউনিয়নের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সাথে মতবিনিময় করেন। তারা ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন ও সাবেক বিচারপতি আবদুল আউয়ালসহ রাজাকারদের বিচার দাবী করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে।

মুক্তিযোদ্ধা পিপি হাফেজ আহমেদ জানান, তিনি ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ট্রেনিং এ ক্লাশ করেছেন। সাবেক বিচারপতি আবদুল আউয়ালসহ অমুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও ফেনীর কোন সেক্টরে যুদ্ধ করতে দেখেন নি। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আবদুল মালেকদেরকে সর্বশান্ত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আবদুল হান্নান জানান, ফেনীতে আবদুল আউয়ালসহ প্রায় তিন শতাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হত্যা করেছে। তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে ভাতা উত্তোলন করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে ও কয়েকবার মানববন্ধনও করা হয়েছে।ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজামান বলেন, বিষয়টি তদন্ত করতে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।