ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে যারা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার দুই অঙ্কের কোঠা ছাড়িয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগের মধ্যে রোববার ঢাকায় ব্যবসায়ীদের এক সভায় বক্তব্যে এই আহ্বান জানান তিনি।সরকারি হিসাবে গত জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন; এদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। তাদের কাছে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

এফবিসিসিআই সভাপতি মহিউদ্দিন বলেন, নন পারফরমিং লোন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যারা অবৈধ পথে ব্যাংক লুট করার উদ্দেশ্যে টাকা নিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হোক।

পাশাপাশি যে সব ব্যবসায়ী লোকসানের কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, তাদের সুযোগ দেওয়ার সুপারিশও করেছেন তিনি।যারা প্রকৃত ব্যবসা করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে, তাদেরকে এক্সিট রুট দেওয়া হোক।ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের পুনঃতফসিলের সুযোগ দিতে আহ্বান জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ৫০০ কোটি টাকার উপরে যারা ঋণ খেলাপি, তাদেরকে ২০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়। এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য তা কেন চালু করা হয় না আমরা জানতে চাই ।

খাতভিত্তিক ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের (অ্যাসোসিয়েশন) সমিতির উদ্যোগে বাজেটের আগে তাদের সদস্যদের সমস্যা শুনতে ঢাকা ক্লাবে এই সভার আয়োজন করে।আলোচনার শুরুতে এফবিসিসিআইয়ের চলমান পাঁচটি প্রকল্পের বিস্তারিত সমিতিগুলোর কাছে তুলে ধরেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম।

এর মধ্যে রয়েছে- টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইকনোমিক পলিসি ইনস্টিটিউট, এফবিসিসিআইয়ের ব্যবসা বিরোধ নিষ্পত্তি কেন্দ্র, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলাম অনুসরণ করে এফবিসিসিআই ইউনিভার্সিটি এবং পূর্বাচলে ৫৪ কাঠা জমির ওপর ৫০ তলা ভবন নির্মাণ।

এফবিসিসিআই সভাপতি মহিউদ্দিন সরকারের উদ্দেশে বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা করার পরিবেশ চাই। ব্যবসায়ীদের যাতে রাস্তায় নেমে নিজেদের অধিকার আদায় করতে না হয়।সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম অবকাঠামো নির্মাণে ১৬টি ছাড়পত্র নেওয়ার পরিবর্তে তা ৪টিতে নামিয়ে আনার যে আশ্বাস দিয়েছেন, তার প্রশংসা করেন মহিউদ্দিন।

তিনি সেইসঙ্গে বলেন, বর্তমানে বন্দরে পণ্য খালাসে ১৪/১৫টি কাগজ লাগে। সিঙ্গাপুরে যেখানে ৪টি কাগজ লাগে, আমাদের সেখানে ৬টি লাগতে পারে। এদিকেও সংস্কারের দৃষ্টি দিতে হবে।

মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে নেওয়াকে দেশের জন্য ‘ইতিবাচক’ উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, রাজনীতি-অর্থনীতি একে অন্যের পরিপূরক। একজন ব্যবসায়ী রাজনীতিতে আসলে তিনি সবচেয়ে বেশি সমাজ সেবা করতে পারেন। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা এবং ব্যবসায় সততা থাকতে হবে।দুই-তিনজন অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য গোটা ব্যবসায়ী সমাজ দায় নেবে না। তাদের চিহ্নিত করতে এফবিসিসিআই সহায়তা করবে।

বিগত দিনে এফবিসিসিআইয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সহকর্মী শেখ ফজলে ফাহিম ও মুনতাকিম আশরাফের সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন মহিউদ্দিন।অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের অন্তত ২০ জন প্রতিনিধি তাদের সমস্যা ও পরামর্শ তুলে ধরেন।

তাদের অধিকাংশই আগামী দুই বছরের জন্য এফবিসিসিআই সভাপতি হিসাবে শেখ ফজলে ফাহিমকে সমর্থনের কথা জানান। এর আগে চেম্বার গ্র“পের এক মতবিনিময় সভায়ও নতুন সভাপতি হিসাবে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছিলেন ফাহিম। অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সবাই ব্যাংক ঋণে সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করতে এফবিসিসিআই নেতাদের পরামর্শ দেন।ফিস ফার্ম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মোল্লা সামছুর রহমান শাহীন বলেন, পিকেএসএফের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার দাবি জানান।

স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ অ্যাসোসিয়েশনের আলী জামান বলেন, যারা একবার ভ্যাট দিতে যায়, তাদের কাছ থেকে বার বার আদায় করা হচ্ছে। যাদের ভ্যাট হয় না, তাদের কাছ থেকেও ভ্যাট আদায় করার চেষ্টা চলে। কিন্তু যারা ভ্যাট এড়িয়ে চলে, তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন না এনবিআর কর্মকর্তারা।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের এবিএম মাসুদ বলেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের পর এই শিল্প এখন বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা সাভারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সিইটিপি চালু হয়নি, ডাম্পিং স্টেশনও চালু হয়নি।আমাদের বলা হয়েছিল সাভারে পরিবেশসম্মত গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি করে দেওয়া হবে। তার কিছুই হয়নি। সিইটিপির জন্য আটবার সময় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখনও সেটা অচল। এই ইন্ড্রাস্ট্রি এখন গলার কাঁটা হয়েছে।সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের মো. শহীদুল্লাহ বলেন, “ব্যাংকের টাকা সব ঋণ খেলাপিদের কাছে চলে গেছে। যার ফলে ছোট মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংকে টাকা চাইলে তারা দিতে পারছে না।

ভোজ্যতেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের গোলাম মাওলা বলেন, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রায় সমালোচনা করা হয়। কিন্তু এই পণ্য নিয়ে কোনো তদারকি নেই। প্রতি দুই মাস পর পর ভোজ্য তেলের বাজার ‘মনিটর’ করে সে অনুযায়ী সুপারিশ তৈরি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, এনসিটিবি টেন্ডারে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেয় যাতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ টেন্ডারে অংশ নিতে পারেন না। এই চক্রকে ভাঙার জন্য টেন্ডারের নীতি শিথিল করতে হবে।

চিনি ব্যবসায়ী সমিতির আবুল হাশেম, স্টিল মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মো. শাহজাহান, পাথর ব্যবসায়ী সমিতির হাজি আব্দুল আহাদ, এয়ার কন্ডিশন ইমপোর্টার সমিতির লুৎফুর রহমান, ক্রোকারিজ অ্যাসোসিয়েশনের মনির হোসেন, ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির ইসমাইল হোসেন, অ্যাম্বেলা ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের হাফিজ আল আসাদ, কালি প্রস্তুতকারী সমিতির এস এ মোমেন, রফিকুল ইসলাম মাসুদ, সরদার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।