আজ দুটো ঘটনা তুলে ধরব যা মনের মাঝে এখনও রয়েছে সাজানো গোছানো এবং মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। ১৯৮৯ সাল, বায়ো টেকনোলজির ওপর কোর্স এবং কনফারেন্স ওয়েস্ট জার্মানির ফ্রাইবার্গে, দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পর সরাসরি যেতে হবে প্যারিসে তারপর ব্যাক টু স্টকহোম। আমি বাংলাদেশের পাসপোর্ট বহন করছি, স্বাভাবিকভাবেই ভিসা নিয়েছি প্রথমে জার্মানির তারপর ফ্রান্সের।সব কিছু ঠিক ঠাক, আমার কলিগ মাটস জোহানসন এবং আমি রওনা দিলাম স্টকহোম থেকে সুইজারল্যান্ডের একটি শহর জুরিখের উদ্দেশ্যে। যদিও ফ্রাইবার্গ জার্মানির একটি ছোট্ট শহর তবুও জুরিখ থেকে বেশ কাছে তাই ল্যান্ড করতেই ঢুকে গেলাম ভুল গেট দিয়ে ফ্রান্সের মধ্যে। আরো মজার ব্যপার জুরিখ এয়ারপোর্ট থেকে সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ফ্রান্স যাবার ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ দেশগুলো বেশ কাছাকাছি থাকার কারণে জুরিখে লান্ড করা বেশ কনভেনিয়ন। ফ্রান্সের গেট থেকে ফ্রাইবার্গের দুরত্ব সবচেয়ে কম বিধায় সেই পথ দিয়ে আমি এবং মাটস বেরিয়ে গিয়েছি। দুই সপ্তাহের কোর্সের পরে ফ্রান্সের জন্য টিকিট বুকিং দিতে পাসপোর্ট চেক করে দেখি যে আমি ভুলবশতঃ জার্মানিতে না ঢুকে ফ্রান্সে আগে ঢোকার কারণে আমার ফ্রান্সের ভিসা শেষ। তাই প্লেনে করে যাওয়া সম্ভব নয়, কি যে করি! আমাদের জার্মানি প্রোফেসর বললেন উপায় একটা আছে তা হলো বাসে করে ঢুকে যেতে হবে, সচারচার চেক হয় না, হলে ফিরে যেতে হবে স্টকহোমে। রিস্ক নিয়ে রওনা দিলাম এবং কোন চেক ছাড়াই প্যারিস ঢুকে গেলাম। প্যারিসে থাকব মোট পাঁচ দিন, আমাদের কনফারেন্সের সব কিছু শেষ করে এবার ঘোরাঘুরির পালা, দুই বন্ধু মনের আনন্দে এনজয় করছি প্যারিস বাই নাইট এন্ড ডে। এদিকে একটু টেনশনে আছি এয়ারপোর্টে তো ধরবে কীভাবে ঢুকলাম বা কেনো ডিউ টাইমে ফ্রান্স ত্যাগ করি নাই! সিদ্ধান্ত নিয়েছি পুরো ঘটনা খুলে বলব এবং যা ঘটেছে তাই বলব। ইমিগ্রেশনে ঢুকতেই জেরা শুরু হলো, সব শোনার পরে বেকসুর খালাশ, ফিরে এলাম সুইডেনে। মাটস এখনও সেই দিনের কথা মনে রেখেছে যা সেদিন দেখা হতে পুরোণো সেই দিনের কথা তুলে ধরল আরো কিছু নতুন বন্ধুদের কাছে। তার কাছে জার্নিটি ছিল ভিন্ন ধরণের, কারণ সুইডিস পাসপোর্টে যারা ট্রাভেল করে তাদের কাছে এসব শুধু কাল্পনিক গল্প যা আমাদের লাল সবুজের পাসপোর্টের জন্য ডালভাত।

 

এ ঘটনার পর বেশি দিন না যেতেই আবার ঘটেছিল এমনটি। সুইডেনের ফার্মাসিয়া এবং অ্যামেরিকান আপজিওন, দুই কম্পানী এক হয়ে নতুন নামে পরিচিত হোল ফার্মাসিয়া এন্ড আপজিওন। স্বাভাবিক ভাবেই কস্ট রিডাশনের ওপর কাজ শুরু হয়ে গেল এবং প্রজেক্টের নাম করণ করা হোল টাইম টু মার্কেট রিডিউজ কস্ট ৭০% (টি টি এম ৭০%) প্রজেক্ট শেষে তার কিক ওফ। আমার ভুমিকা এই প্রজেক্টর ওপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আমার এবং আমার ডিপার্টমেন্টের পারফরমেন্স ছিল অতুলনীয় বিধায় ফিনল্যান্ডের বড় জাহাজ, সিলিয়া লাইন পুরোটাই ভাড়া করে কনফারেন্স, সঙ্গে কিক ওফ পার্টি, পুরো টিমের সমন্বয়, বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে ৭৫০ জন কলিগের সাথে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির উদ্দেশ্য রওনা দিতে স্টকহোমের ভার্টাহামনে জড়িত হয়েছি। জাহাজ ছাড়বে সন্ধা ৬ টায়, একে একে সবাই জাহাজে উঠে গেলো, আমার যাবার সময় হোল হটাৎ পুলিশ কন্ট্রোল! আমার সুইডনের ভিসা রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফিনল্যান্ডের ভিসা নাই তাই জাহাজে ঢুকতে বাঁধা দিল পুলিশ। এদিকে সন্ধা ৬টা বাজতে চলেছে জাহাজ ছাড়তে হবে, ফিনল্যান্ডের অ্যাম্বাসিও বন্ধ, কী করা! হঠাৎ খবর পৌছে গেল জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে, ক্যাপ্টেন এসে হাজির, পুলিশের সঙ্গে কথোপকথনের পর ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্তে আসলো “ আমি জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং জাহাজের পুরো দায়িত্ব আমার বিধায় রহমান জাহাজে যাবে তবে সে হেলসিঙ্কিতে ল্যান্ড করবে না”। এ শর্তে পুলিশের আর কিছুই করায় নাই। আমি জাহাজে উঠে গেলাম। সেদিন হয়েছিল এক্সট্রা পার্টি যেনো মনে হয়েছিল সবাই স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করছে, আমার চোখে সেদিন জল এসেছিল সবার ভালবাসা দেখে যে আমাকে ছাড়া ৭৫০ জন কলিগের কেউ যাবে না! সুইডেনে পারমানেন্ট রেসিডেন্স পারমিশন রয়েছে সত্যি কিন্তু যখনই কোথাও ট্রাভেল করতে যেতে হবে, বাংলাদেশের পাসপোর্ট বিধায় হ্যারাজমেন্টস ছিল সত্যি এক দুঃখের বিষয়, শেষ পর্যন্ত ফার্মাসিয়া এন্ড আপজিওন সিদ্ধান্ত নিল আমার সুইডিস পাসপোর্টের।আমার বিশ্ব ভ্রমনের কারণে সুইডিস পাসপোর্ট ব্যবহার করা হয় মুলত, সঙ্গে ভাবতে লেগেছি বাংলাদেশের পাসপোর্টকে কীভাবে সুইডেনের মত করা সম্ভব! হ্যাঁ তা অবশ্যই করা সম্ভব। বাংলাকে করতে হবে সোনার বাংলা এবং একদিন গর্বের সঙ্গে সুইডিস পাসপোর্টের মত করে শুধু পাসপোর্ট দেখাব আর ঢুকে যাব পৃথিবীর যে কোন দেশে। যদিও ছেলে-মেয়ের সুইডিস, বাংলাদেশ ও স্পেনিশ পাসপোর্ট রয়েছে তার পরও লালসবুজের পাসপোর্টে দেশ বিদেশ ঘুরতে চাই গর্বের সাথে। এই গর্ব অর্জন করা সম্ভব যদি আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সমন্বয়, যদি আমাদের দেশের প্রতি গড়ে ওঠে আবেগ ও ভালবাসা, যদি আমারা দুর্নীতি মুক্ত করতে পারি নিজেদেরকে, যদি আমরা গড়তে সক্ষম হই সুশিক্ষার বাংলাদেশ, যদি আমরা দেখাতে পারি গনতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিস বাংলাদেশে, যদি আমাদের মধ্যে ভেদাভেদের দুরত্ব কমিয়ে আনতে পারি, নিশ্চিত বাংলাদেশ হবে রেসপেক্টেড কান্ট্রি লাইক সুইডেন।

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে।