গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালার শর্ত পূরণ না করলে যেকোনো রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া থেকে বিরত ও নিবন্ধন বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু ইসির এই দুটি আইনে এমন কোনো বিধান নেই, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো গঠনতন্ত্রে কোন ধারা রাখবে কি রাখবে না, তা র্নিধারণ করতে পারে। তা ছাড়া কোনো দলের গঠনতন্ত্র গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়েও ইসির সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই।
গঠনতন্ত্র নির্ধারণ, গ্রহণ বা বর্জনের বিধান না থাকা সত্ত্বেও ৭ নম্বর ধারা বাতিল করে সংশোধিত বিএনপির গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এ ছাড়া এক মাসের মধ্যে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন কেন অবৈধ নয় এর ব্যাখ্যা ইসির কাছে চেয়েছে হাইকোর্ট। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ অক্টোবর, বুধবার হাইকোর্ট ওই নির্দেশনা জারি করায় অনেকটা দোটানায় পড়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মত, রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে কি থাকবে না থাকবে সেটা তাদের নিজস্ব এখতিয়ারের বিষয়, নির্বাচন কমিশনের নয়। কমিশন রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ। দলগুলো আইন-কানুন মানছে কিনা তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইসির।
রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত তাদের গঠনতন্ত্র নির্ধারণ করে সাংগঠনিকভাবে। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গঠনতন্ত্রের সংযোজন-বিয়োজন বা সংশোধন করে থাকে তারা। তেমনিভাবে ২০১৬ সালের মার্চে ৭ নম্বর ধারা বাদ দিয়ে গঠনতন্ত্রের সংশোধনী প্রস্তাব কাউন্সিলের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেয় বিএনপি। কিন্তু নির্দেশ থাকায় হাইকোর্টের কাছে ইসিকে এখন জবাবদিহি করতে হবে, বিএনপি ৭ নম্বর ধারা গঠনতন্ত্র থেকে বাদ দিতে পারবে কি না। নিবন্ধন বিধিমালার ৯ ধারার ‘ঘ’ উপধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারে ইসি। এই ব্যাপারে এক ইসি কমিশনার গণমাধ্যমকে বলেছেন, হাইকোর্টের নির্দেশ থাকায় বিএনপির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। যদিও ১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, কমিশন সভায় আলোচনা করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আইনত বিএনপির গঠনতন্ত্রে যদি কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে সেটা সংশোধন করে দিতে বলব। তা ছাড়া দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু থাকলেও সংশোধন করে দেওয়ার জন্য বলতে পারি।’
বিএনপির গঠনতন্ত্রের বাদ দেওয়া ৭ নম্বর ধারাটি হলো- ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি, দেউলিয়া, উন্মাদ ও দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত ব্যক্তি দলটির জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীপদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
হাইকোর্ট বলছে, বিএনপির গঠনতন্ত্রের এই ৭ নম্বর ধারাটি বহাল রাখতে। এ ছাড়া অন্য কোনো ধারা নিয়ে আপত্তি নেই হাইকোর্টের। এই হিসাবে ধারাটি বাদ দিলেও বিএনপির গঠনতন্ত্রে প্রচলিত আইন বা সংবিধান বিরোধী কোনো কিছুই থাকছে না।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একটা জিনিস মনে রাখবেন, আমরা আদালতের ঊর্ধে না। হাইকোর্টের আদেশ আমরা মেনে চলতে বাধ্য। এখন কেউ যদি মনে করে, হাইকোর্ট কেন দিল এই ধরনের আদেশ, তাহলে বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাইকোর্টকেই এই ধরনের প্রশ্ন করতে হবে।’
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২-এর ‘ঘ’ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়ে দুই বছরের বেশি দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হন এবং তার মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়, তাহলে তিনি সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা বাদ দিয়েছে। ধারাটা বাদ দেওয়ায় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার তৈরি হয়েছে। এই গ্রাউন্ড থেকে আদালত ব্যাখ্যা চাইতে পারে, এমন একটা বিধান থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন তা বাতিল করলেন।’
মঞ্জুরুল হক আরও বলেন, ‘আদালত যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারে। এখন বিএনপি যদি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে যে, সংবিধানে লেখার (অনুচ্ছেদ) সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নাই। আদালত বলেছে, এই একমাস যেন বিএনপির যে গঠনতন্ত্র তা গ্রহণ না করতে। একমাস পরে যদি বিএনপি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে, তাহলে কমিশন গ্রহণ করবে। আর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে গঠনতন্ত্র আগে যেরকম ছিল, সেটাকেই বহাল রাখতে হবে।’
এই ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে কি থাকবে, সেটা রাজনৈতিক দলের এখতিয়ার, নির্বাচন কমিশনের নয়।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ। রাজনৈতিক দলগুলো আইন-কানুন, বিধি-বিধান মেনে চলল কি না, রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ হিসেবে সেটা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। কমিশন দেখবে গঠনতন্ত্র আইনসম্মত, বিধিসম্মত কি না। বিধির ব্যত্যয় হলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে।’
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। পাশাপাশি তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে দেওয়া হয় ১০ বছর করে কারাদণ্ড। এরকম বাস্তবতায় বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা সাংগঠনিকভাবে বাতিল করে।
গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বিলুপ্ত করলে এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট করেন রাজধানীর কাফরুলের ঠিকানা দেওয়া মোজাম্মেল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। ওই রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মাদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ইসিকে বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্দেশনা দেয়। রিটকারী মোজাম্মেল হোসেন নিজেকে বিএনপিকর্মী দাবি করেন। সম্প্রতি রিট আবেদনে দেওয়া ঠিকানায় তার খোঁজ করতে কাফরুলের যান এক সংবাদকর্মী। কিন্তু ওই নামের কোনো ব্যক্তিকে উক্ত ঠিকানায় পাওয়া যায়নি।