একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেরা একসঙ্গে কয়েকটি কর্মসূচি পালনের পর বিএনপিকেও সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী ঐক্য প্রক্রিয়া’র রূপরেখা চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন কামাল হোসেন ও এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।কিন্তু শনিবার সেই রূপরেখা চূড়ান্তের আগেই তাতে ফাটল ধরেছে; নির্ধারিত সেই বৈঠক না হওয়ার পর দুজনের পক্ষ থেকে সন্ধ্যায় আলাদা সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে।জগাখিচুড়ি এই ঐক্য টিকবে না’- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের এই বক্তব্যই কার্যত ফলতে যাচ্ছে সরকারবিরোধী এই দলগুলোর ঐক্য প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে।
সংসদ ভেঙে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং ইসি পুনর্গঠনের ৫ দফা দাবিতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর একযোগে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল বি চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ও কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া।তারপর তারা কয়েকটি কর্মসূচি পালন করে, যাতে ৭ দফা দাবি তুলে আসা বিএনপির নেতারাও যোগ দেন। তবে এরপরই বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে আসার শর্ত দেয় বি চৌধুরীর দল বিকল্প ধারা।
জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির কোনো স্পষ্ট বক্তব্য না আসার মধ্যেই ঐক্য প্রক্রিয়ার রূপরেখা চূড়ান্ত করতে শনিবার বিকালে কামাল হোসেনের বাড়িতে এক সঙ্গে বসার কথা ছিল যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও বিএনপি নেতাদের। বৈঠকে যোগ দিতে যুক্তফ্রন্টের আহ্বায়ক বি চৌধুরী বেলা সাড়ে ৩টার দিকে কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় যান ছেলে বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরীকে নিয়ে।কিন্তু বাড়ির দরজা বন্ধ দেখে গাড়িতেই কিছুক্ষণ বসে থেকে ফিরে যান তারা।মাহি সাংবাদিকদের বলেন, বাসায় দাওয়াও দিয়ে গেইট েেখালার কেউ নেই! একজন সাবেক রাষ্ট্রপতিকে এভাবে ডেকে এক রকম ব্যবহার কোনো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না।সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আমরা সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করব।এদিকে বি চৌধুরী যখন তার বাড়ির ফটকে, তখন মতিঝিলে নিজের পেশাগত চেম্বারে আরেক বৈঠকে ছিলেন গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন।
ওই বৈঠকে তার সঙ্গে ছিলেন বি চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের শরিক দল জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও যুক্তফ্রন্টের সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান মান্না।বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ছিলেন সেই বৈঠক।ওই বৈঠক থেকে সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা আসে।দুই পক্ষ আলাদা সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও বিভাজনের বিষয়ে কোনো পক্ষের স্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। বাসায় বি. চৌধুরীকে ডেকে কেন দেখা করেননি সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গণফোরামের যুগ্ম সম্পাদক আ ও ম শফিকুল্লাহ জানান,‘ ড. কামাল হোসেনের পক্ষ থেকে বি. চৌধুরীকে জানানো হয় তিনি (ড. কামাল) এখন মতিঝিলের অফিসে রয়েছেন, তিনি যেন সেখানে আসেন। কিন্তু, তারা মতিঝিলে না এসে বেইলি রোডে তার বাসায় গিয়েছেন। সেসময় তিনি বাসায় ছিলেন না।
এদিকে ঐক্য প্রক্রিয়ার বিভিন্ন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুর থেকেই ড. কামাল হোসেন তার মতিঝিলের চেম্বারে দফায় দফায় বৈঠক করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন ঐক্য প্রত্যাশী নেতার সঙ্গে।ঐক্য প্রক্রিয়ার একজন নেতা জানান, বিএনপি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেখানে বিকাল তিনটার দিকে এসে সাড়ে তিনটায় বেরিয়ে যান। এরপর তিনি পাশেই ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের চেম্বারে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বিকাল চারটার দিকে মির্জা ফখরুল আবার ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে প্রবেশ করেন।
এদিকে, মাহী বি. চৌধুরী জানিয়েছেন,উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে আজ সন্ধ্যায় বারিধারায় বি.চৌধুরীর বাসভবনে বিকল্প ধারার পক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে কথা বলবেন বিকল্পধারা সভাপতি ও যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান বি.চৌধুরী।উল্লেখ্য, সরকারবিরোধী বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্য সমমনা দলগুলোর প্রতি ড. কামাল হোসেন সম্প্রতি আহ্বান জানালে ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার এসংক্রান্ত অনুষ্ঠানে যোগ দেন যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা সভাপতি বি. চৌধুরী। ওই অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির স্থায়ী কমিটির আরও কয়েকজন নেতাও ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মূলত সেদিনই বোঝা যায় বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে যাচ্ছে। তবে এরপর বি. চৌধুরীর বাসায় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের এক বৈঠকে ডেকে বি. চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী কোনও দলের সঙ্গে তারা নির্বাচনকালীন ঐক্য গড়বে না। এক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় বিএনপিকে এই জোটে আসতে হলে জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দলগুলোকে ছেড়েই আসতে হবে। একইসঙ্গে জোট গড়ার আগেই আসন ভাগাভাগি ও সরকার গঠন করলে কার কী ভূমিকা থাকবে তা স্পষ্ট করার দাবিও ছিল তাদের। তবে সেদিনের বৈঠকে উপস্থিত এক নেতার ফোন লন্ডনের একটি ফোনে সংযুক্ত রয়েছে মাহী বি. চৌধুরীর দেওয়া এমন খবরে তড়িঘড়ি বৈঠক শেষ করে দেন বি. চৌধুরী। তখন থেকে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার বিষয়টি নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। এদিকে, ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে বিএনপিকে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে জোটভুক্ত দলগুলো। তখন পরবর্তীতে বিএনপি যা করবে জোটের সবার সঙ্গে কথা বলে করবে বলে তাদের প্রতিশ্র“তি দেয়।এরপর দুইবার বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার বিষয়ে জোট গঠনের ঘোষণা দেওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ আজ শনিবার (১৩ অক্টোবর) বিকালে ড. কামাল হোসেনের বাসায় বৃহত্তর ঐক্যের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরে তা বাতিল করেন তিনি। আর বি.চৌধুরীর সঙ্গে বাসাতেই পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাতের কথা থাকলেও সেসময় মতিঝিলের অফিসে থাকায় তার বাসার দোরগোড়া থেকে ফিরে যান যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী।