জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া আদালতে না আসায় তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে বলে আদেশ দিয়েছেন আদালত।এ আদালতে শুনানির আগের দুই দিনের মত বৃহস্পতিবারও খালেদা জিয়াকে হাজির করতে না পেরে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান এ আদেশ দেন। বৃহস্পতিবার বেলা ১টা ২০ মিনিটে এই আদেশ দেওয়া হয়।
বিচারক বলেন, এক বছর ৯ মাস মামলাটি যুক্তিতর্কের পর্যায়ে থাকায় এবং আসামি বেগম খালো জিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে হাজির না হওয়ায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারায় প্রসিকিউশনের দরখাস্তটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে গ্রহণ করা যায়।আদেশে বলা হয়, এ মামলার আসামি খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত হাজিরা অন্তবর্তী সময়ের জন্য মওকুফ করা হল। মামলার কার্যক্রম যথারীতি চলবে। তার আইনজীবীরা চাইলে আদালতে তার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে পারবেন।আসামিপক্ষ এদিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার আবেদন করলে বিচারক কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।পরে এ মামলার অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক শুনানি আবার শুরু করার আনুষ্ঠানিক আদেশ দিয়ে ২৪, ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুনানির সময় ঠিক করে দেন বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান।
দিনের শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, প্রসিকিউশন তাদের পিটিশনের পক্ষে তেমন কোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেনি। আদালত প্রসিকিউশনের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে আদেশ দিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে গত ৮ ফেব্র“য়ারি থেকে ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে।অসুস্থতার কারণে’ তাকে গত সাত মাসে একবারও আদালতে হাজির করতে না পারায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ করতে সরকারের নির্দেশে আদালত স্থানান্তর করা হয় কারাগারের ভেতরে।গত ৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ জজ আদালতের এই অস্থায়ী এজলাসে শুনানির প্রথম দিন খালেদা জিয়া নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে বিচারককে বলেছিলেন, তিনি বার বার আদালতে আসতে পারবেন না, বিচারক তাকে যতদিন খুশি সাজা দিতে পারেন।
এরপর ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির নির্ধারিত দিনে কারা কর্তৃপক্ষ খালেদাকে আদালত কক্ষে আনতে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারা অনুযায়ী তার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চালানোর আর্জি জানান দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। বিচারক আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ঠিক করে দেন। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন তার দুই আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও সানাউল্লাহ মিয়া। আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্নার পক্ষে অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম এবং মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে আইনজীবী মো. আক্তারুজ্জামান ছিলেন শুনানিতে।
আর মামলার বাদী ও তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এছাড়া ঢাকা মহানগর আদালতের বিশেষ পিপি আবদুল্লাহ আবু রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন।বিচারক বলেন, সাত বছর ধরে এ মামলার বিচার চলছে। মামলার বিচার চলার সময় শুরু থেকে আসামিরা ৪০ বার, যুক্তি-তর্ক চলার সময় ৩২ বার সময় নিয়েছেন। এভাবে সময় পেছানো হলে মামলাটি দীর্ঘদিন অনিষ্পন্ন থেকে যাবে।এ ধরনের ক্ষেত্রে আসামির হাজিরা মওকুফের উদাহরণ দিতে গিয়ে ভারতের রাজস্থান, উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশের তিনটি রায়ের প্রসঙ্গ টানেন বিচারক।
তিনি বলেন, কোনো পক্ষ আবেদন না করলেও আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং বিচার যেন বিলম্বিত না হয় সেজন্য হাজিরা মওকুফ করতে পারে। কেউ দরখাস্ত না দিলেও ৫৪০ (এ) ধারায় কারও মৌখিক আবেদনের প্রেক্ষিতে কারও হাজিরা মওকুফ করতে পারে আদালত।আর এ মামলার আসামি খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে বিচারক বলেন, নথিপত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আসামি ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে হাজির হচ্ছেন না। এটা বিচার বিঘ্নিত ও বিলম্বিত করতে পারে।৫৪০ (এ) ধারায় যা বলা আছে: ওই ধারার (১) অংশে বলা হয়েছে- দুই বা ততোধিক আসামি আদালতে হাজির থাকলে এই বিধির অধীন অনুসন্ধান বা বিচারের যে কোনো পর্যায়ে জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট যদি কোনো কারণবশত সন্তুষ্ট হন যে, আসামিদের এক বা একাধিক আদালতে হাজির থাকতে অসমর্থ, তাহলে ওই কারণ লিপিবদ্ধ করে আসামির কৌঁসুলি হাজির থাকলে আসামিকে হাজিরা হতে রেহাই দিতে এবং তার অনুপস্থিতিতে অনুসন্ধান বা বিচার চালিয়ে যেতে পারবেন এবং কার্যধারার পরবর্তী পর্যায়ে ওই আসামিকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির থাকতে নির্দেশ দিতে পারবেন।(২) অংশে বলা হয়েছে, এইরূপ কোনো মামলায় আসামির কৌঁসুলি না থাকলে, অথবা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামির হাজিরা প্রয়োজন মনে করেন, তা হলে তিনি উপযুক্ত মনে করলে অনুসন্ধান বা বিচার মুলতবি রাখতে পারবেন, অথবা উক্ত আসামির মামলার পৃথকভাবে গ্রহণ করার বা বিচারের আদেশ দিতে পারবেন।
আসামি পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেন, যেহেতু তিনি কারাবন্দি, তার ক্ষেত্রে ৫৪০ (এ) ধারা কর্যকর হতে পারে না।সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, তিনি অসুস্থ। তার পক্ষে আদালতে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তিনি অনিচ্ছুক। তিনি আমাদের বলেছেন, অন্য আসামিদের যুক্তি-তর্ক তিনি শুনতে চান। তিনি আদালতে উপস্থিত থাকতে চান। তিনি সুস্থ হলে অবশ্যই আদালতে আসবেন। তার জামিন বৃদ্ধি করে দেন। তিনি সুস্থ হলে আদালতে আসবেন।খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বিচারককে বলেন, আপনি তার জামিন বৃদ্ধি করে দেন। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা হোক।
৫৪০ (এ) ধারার বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য খালেদার আইনজীবীরা সময়ের আবেদন করলে বিচারক বলেন, আজকে আদেশের জন্য দিন নির্ধারিত আছে। আজকে বক্তব্য শুনব কেন? ১৩ তারিখে বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। ওইদিন আপনারা দেননি। আজকে আমরা বক্তব্য নেব না।এ নিয়ে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে আসামি জিয়াউল হক মুন্নার আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা কি দেবতা? তিনি ওই দিন পিটিশন চেয়েছেন, আর ওই দিনই আমাদের ওই বিষয়ে বক্তব্য দিতে হবে। এখানে লাইব্রেরি নেই, বইপত্র নেই। প্রস্তুতি ছাড়া ওই দিনই কীভাবে বক্তব্য দেই?
এখন আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ব্যাখ্যা না শুনলে তা ‘ন্যায়বিচারের পরিপন্থি’ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।এরপর আদালত তাদের বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি দিলে আমিনুল ইসলাম পাকিস্তানের একটি উদাহরণ টেনে বলেন, কাস্টডির আসামির ক্ষেত্রে ৫৪০(এ) ধারা কার্যকর হবে না।কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, উনি অনিচ্ছুক। আর আইনে আছে- ‘তিনি যদি সক্ষম না হন’। এ দুটি সাংঘর্ষিক ব্যাপার।মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ৫৪০ (এ) ধারায় বলা আছে, আসামি অক্ষম হলে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে তার হাজিরা হবে।আমরা আসামিকে রিপ্রেজেন্ট করছি না। উনি কাস্টডিতে আছেন। উনাকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ আমাদের নাই। আমরা তাকে এখানে শুধু ডিফেন্ড করছি। বেলা ১টা ২০ পর্যন্ত শুনানি চলার পর বিচারক খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চালানোর আদেশ দিলে আদালত বিরতিতে যায়।দুপুর ২টার পর আবার আদালত বসলে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে আসামিপক্ষের নতুন একটি আবেদনের ওপর মিনিট দশেক শুনানি হয়। আদেশে বিচারক কারা বিধি অনুযায়ী খালেদার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেন। পরে তিনি যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য ২৪, ২৫, ২৬ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করে দিলে দিনের শুনানি শেষ হয়।খালেদা জিয়ার মামলার বিচারের পাশাপাশি আশুরার তাজিয়া মিছিলের কারণে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পুরনো কারাগার এলাকা সকাল থেকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়।