৬ বছর বয়সের একটি ছবিকে সম্বল করে নিজের মা ও বাবা আর জন্মস্থানের খোঁজে গত প্রায় ১১ দিন যাবত পাবনার বেড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম সস্ত্রীক চষে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ডেনিশ নাগরিক মিন্টো কারষ্টেন সোনিক। তিনি নিজেও নিশ্চিত নন তার বাড়ী পাবনার বেড়া উপজেলায় না অন্য কোথাও। শৈশবের ছবির সাথে পাওয়া একটুকরা কাগজের ঠিকানায় পাবনার ‘নগরবাড়ী ঘাট’ নামক জায়গার খোঁজ করতে করতে চলতি মাসের শুরুতে স্বস্ত্রীক পাবনায় এসেছেন তিনি। তারপর থেকে অবিরাম চলছে মিন্টোর শেকড়ের অনুসন্ধান। বিষয়টি জানাজানি হবার পর অনেকেই এসে নিজেকে দাবী করছেন মিন্টোর মা কিংবা বাবা হিসাবে। কিন্তু তাদের কথাবার্তা আর আচরনে বিভ্রান্তি থাকায় হতাশ হয়ে পড়ছেন প্রায় ৫০ বছরের এই ডেনিশ নাগরিক।
বুধবার দুপুরে পাবনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে মিন্টো নিজের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, তার গ্রামের বাড়ী কোথায়, কে তার মা বাবা কিছুই মনে নাই তার। ৬ কিংবা ৭ বছর বয়সে একদিন সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী থেকে অনেক দূরে চলে আসেন তিনি। পথ চিনতে না পেরে রাস্তার পাশে কাঁদছিলেন। এক ভদ্রলোক তাকে পেয়ে নিজের জিম্মায় রাখেন। পরে ওই ভদ্রলোক তাকে ঢাকার ঠাটারী বাজারের একটি অনাথ আশ্রমে ভর্তি করে দেন। পরে অনাথ আশ্রমের একটি কাগজ থেকে জেনেছিলেন ওই ভদ্রলোকের নাম ছিলো চৌধুরী কামরুল ইসলাম। ১৯৭৮ সালে ওলে ও বেনফি নামের ডেনিশ দম্পতি দত্তক নিয়ে ডেনমার্ক নিয়ে যান মিন্টোকে। সেই থেকে ডেনমার্কেই তার বড় হওয়া এবং বিয়ে করেন। মিন্টোর ডেনিশ স্ত্রী এনিটি হোলমিহেভ পেশায় একজন অডিওলজিষ্ট (শ্রুতি চিকিৎসক)। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মিন্টো একজন চিত্রশিল্পী।
এতোবছর পর কেনো হঠাৎ মা বাবার কথা মনে হলো এ এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মিন্টো জানান, ডেনমার্কে তার শৈশব, কৈশর খুবই ভালো কেটেছে। ১৩-১৪ বছর বয়সে একটা কিশোর যখন প্রথম নারী-পুরুষের সম্পর্ক বুঝতে শুরু করে সেই সময়টা থেকে তার মনে প্রশ্ন জাগতে থাকে কে তার মা? কে তার বাবা? প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে তিনি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এই হতাশা তাকে নেশার অন্ধকার জগতে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে কোকেন, এলএসডি‘র মত ভয়ংকর সব নেশা সঙ্গী হয় তার। এসময় তিনি রুক্ষ হয়ে ওঠেন। আর এভাবেই অন্ধকারে কেটে যায় তার খৈশর, যৌবন। বয়স যখন ৪১ তখন প্রথম নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে আনার চেষ্টা করেন। এসময় আবারো তাকে গ্রাস করে মা বাবার পরিচয়ের বিষয়টি। মিন্টো জানালেন, তখন পরিবারের লোকজনের সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করতেন। মাঝে মধ্যেই মেজাজ খিটমিটে হয়ে যেত, কোনো কিছুই ভালো লাগতো না তার। অবশেষে পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে স্ত্রী এমিটিকে সাথে নিয়ে ছোট বেলার একটি ছবিকে অবলম্বন করেই ছুটে আসেন পাবনায়।
ছবির সাথে তার সঙ্গী শৈশবের সেই অনাথআশ্রমের একটি চিরকুট। যেখানে লেখা আছে কামরুল ইসলাম চৌধুরী নামের এক ভদ্রলোক তাকে নগরবাড়ী এলাকা থেকে সেখানে (অনাথ আশ্রমে) পৌছে দিয়েছিলেন। এর মাঝে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে পাবনার স্বাধীন বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির সাথে। তার সহযোগিতায় গত প্রায় ১১ দিন ধরে তিনি পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী সহ পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলছেন। নিজের ছেলেবেলার সেই ছবি দেখিয়ে সবার কাছে জানতে চাইছেন এলাকার কোনো বাড়ী থেকে এই চেহারার কোনো ছেলে ৩০-৪০ বছর আগে হারিয়ে গেছে কি না। পাশাপাশি সবার মাঝে একটি লিফলেট বিতরণ করছেন। সেখানে লেখা রয়েছে “১৯৭৭ সালের দিকে প্রায় ৪০ বছর আগে আপনি কি আপনার পরিবারের কোনো সদস্যকে হারিয়েছেন?”
নিজের শেকড় অনুসন্ধানে নেমে মিন্টোকে পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। আলাপকালে তিনি জানান, ইতোমধ্যে ৫ থেকে ৬ জন নারী পুরুষ পাবনায় এসে নিজেকে মিন্টোর মা অথবা বাবা বলে দাবী করেছেন। তাদের প্রত্যেকের কথাই বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে। তাদেরকে যখনই ডিএনএ টেষ্ট এর কথা বলা হয়েছে তখনই তারা সটকে পড়েছে। মিন্টো বলেন, এতো বছর পর নিজের মা বাবাকে সঠিকভাবে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন কাজ। তার পরেও তিনি আশাবাদী পেয়ে যাবেন তার মা বাবা সহ শেকড়ের সব ঠিকানা। পাবনাতে এসে তিনি সস্ত্রীক উঠেছেন একটি হোটেলে। গত ১১ দিনের সন্ধানে আশা জাগার মত কোনো তথ্যই মিন্টো পাননি। সকাল বেলায় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পথে পথে চলে তার খোঁজ। বাংলা বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না। কিন্তু বুকে হাত রেখে বাবা-মায়ের কথা বোঝাতে চান এবং তাদের সন্ধান চান। মিন্টোর ডেণিশ স্ত্রী এমিটি জানালেন, বাংলাদেশের মানুষদের আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করেছে। তিনিও মনে করেন এতো বছর পরে এটা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার তার স্বামীর পিতা মাতা বা স্বজনদের খুঁজে বের করা। তারপরেও যদি খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সেটা অনেক বড় একটা কাজ হবে।
সবশেষে মিন্টো আরো জানালেন, শেকড়ের কথা মনে হলে আমি প্রচ- শুন্যতা অনুভব করি। যদি বাবা, মায়ের খোঁজ পাই তাহলে সেটা অসাধারণ হবে। না পেলে মৃত্যুর আগে জানব তাদের খুঁজে পেতে আমি চেষ্টা করেছিলাম।
মিন্টোর শেকড় অনুসন্ধানে সহযোগিতা করছে পাবনার প্রশাসনও। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামিমা আকতার বলেন, বিষয়টি আমরা জেনেছি। পুলিশের পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করার আমরা করছি। ইতিমধ্যেই তিনি পাবনা সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আমাদের পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমগুলোরও মিন্টুর পাশে দাঁড়ানো দরকার। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন সার্বিক সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।