৩০অক্টোবরের পর যে কোনো দিন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। সোমবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের এ কথা বলেছেন।রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসি সচিব সাংবাদিকদের বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণ, ১০ কোটি ৪১ লাখ ভোটারের তালিকার কাজ শেষ হয়েছে। ভোটার তালিকার সিডি করা হয়েছে। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব জেলা এবং উপজেলাতে এই সিডি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। গত ৫ আগস্ট ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। দাবি আপত্তি শুনানি শেষে ভোটকেন্দ্র নীতিমালা অনুসারে সব ঠিক করে ৬ সেপ্টেম্বর মাঠপর্যায়ে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এখন সেগুলো কমিশনে পাঠাবে। তারপর সেগুলো যাচাই–বাছাই করে নির্বাচনের ২৫ দিন আগে ভোটকেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ করা হবে।
তফসিল ঘোষণার মাস দু-এক আগে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধন আনার উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। ইতিমধ্যে সংশোধনী প্রস্তাব ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে। তাতে ব্যালটের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়ার সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু আর কী কী সংশোধনী ইসি চেয়েছে, তা পরিষ্কার করেনি সংস্থাটি। এ বিষয়ে গোপনীয়তা কেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হেলালুদ্দীন বলেন, কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। আরপিও সংশোধন প্রস্তাব ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ভেটিং অনুমোদন হলে মন্ত্রী সভায়, সংসদে পাস হবে। তারপর সবাই জানতে পারবেন। সবকিছু আগ থেকে জানাতে হবে, এমন তো কোনো প্রবিধান নাই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুরোদমে কাজ গোছাতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।এ লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণার আগে-পরে দুই ধাপের অন্তত ৯০টি কাজ চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী এগোচ্ছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।আসছে ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ইতোমধ্যে বলেছেন, ডিসেম্বরের শেষ দিকে ভোটের জন্য নভেম্বরের শুরুতে তফসিল দেওয়া হতে পারে। কমিশনের বৈঠকে ভোটের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির শুরুতে ভোট হবে। শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষা ও বিশ্ব ইজতেমার সময়কেও বিবেচনায় নেবে কমিশন।এসব বিষয় মাথায় রেখেই সেপ্টেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসূচি’র খসড়া কমিশনে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসি কর্মকর্তারা।
দশম সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। তফসিল ঘোষণা করা হয় ২৫ নভেম্বর। বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল ওই নির্বাচন বর্জন করে।তার আগে নবম সংসদ নির্বাচনের তফসিল হয় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর। তিন দফা তারিখ পরিবর্তন করে ভোট হয় ২৯ ডিসেম্বর।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে ৬০ দিন, দ্বিতীয় ৫৪ দিন, তৃতীয় ৪৭ দিন, ৪র্থ ৬৯ দিন পঞ্চম ৭৮ দিন, ষষ্ঠ ৪৭ দিন, সপ্তম ৪৭ দিন, অষ্টম ৪২ দিন, নবম সংসদ নির্বাচন ৪৭ দিন ও দশম সংসদ নির্বাচনে ৪২ দিন সময় হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা করেছিল কমিশন।ইসি সচিব হেলালুদ্দীন বলেন, গত সংসদের প্রথম অধিবেশন হয়েছিল ২৯ জানুয়ারি। সে হিসাবে এবার ভোটের ৯০ দিনের ক্ষণ গণনা শুরু হবে ৩০ অক্টোবর থেকে।তিনি বলেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করার মতো প্রস্তুতি আছে আমাদের। নির্বাচন কমিশন এখনও ওইভাবে আলোচনা করেনি তারিখ নিয়ে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ডিসেম্বরের শেষার্ধে অথবা জানুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন হবে।”
ইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটের ক্ষণ গণনার শুরু থেকে ফলাফলের গেজেট করা পর্যন্ত অন্তত ৯০টি কাজ চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনা সাজাচ্ছেন তারা।প্রথম ধাপে ভোটকেন্দ্রের তালিকা, পুননির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রস্তুত, নির্বাচন সামগ্রী কেনাকাটা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত, প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নির্বাচনী ম্যানুয়াল তৈরি, মনোনয়নপত্র মুদ্রণসহ আনুষঙ্গিক কাজ সেপ্টেম্বরে-অক্টোবরে শেষ করা হবে। তফসিল ঘোষণার পর শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপের কাজ।হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ভোটার তালিকার কাজ শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের খসড়া হয়েছে। দ্রব্য-সামগ্রী কেনার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের সভায় এসব কিছুর অগ্রগতি, নির্বচনী কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা, আর্থিক বরাদ্দসহ সার্বিক বিষয় আলোচনা হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় শাখার কর্মকর্তারা জানান, তফসিল ঘোষণার পর কর্মকর্তা নিয়োগ, মন্ত্রিপরিষদসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা, রিটার্নিং কর্মকর্তার জন্য পরিপত্র জারি, আচরণবিধি প্রতিপালন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন, নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োগে ব্যবস্থা, ভোটকেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ, সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের অনুমতি, মাঠ পর্যায়ে সামগ্রী বিতরণ এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাসংস্থার সঙ্গে বৈঠক থাকবে।প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা পাওয়ার পর ব্যালট পেপার মুদ্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা এবং আইন শৃঙ্খলা প্রধানদের সঙ্গে ‘বিশেষ পর্যালোচনা বৈঠক’ কমিশন নির্ধারণ করবে।দ্বিতীয় দফা বৈঠক করে সেনাসহ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য মোতায়েনের ‘টাইমফ্রেম’ নির্ধারণ করা হয়।আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলে সশস্ত্রবাহিনী বিভাগকে অনুরোধ করবে ইসি।
সিইসি কে এম নূরুল হুদা ইতোমধ্যে বলেছেন, আগেও সেনা মোতায়েন হয়েছে। এবারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি; সেনা মোতায়েন হবে কিংবা সেনা মোতায়েন হবে না- এমন সিদ্ধান্ত এখনই বলা যাবে না। ভোটের আগে পরিস্থিতি বুঝে আমরা সিদ্ধান্ত জানাব।সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সশস্ত্রবাহিনী নিয়োগ দেয় ইসি। দশম সংসদ নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে ছিলেন ১৫ দিন।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১০ কোটি ৪৩ লাখেরও বেশি ভোটার থাকবে। সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র হবে ৪০ হাজারের বেশি।প্রতিটি কেন্দ্রে একজন করে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, প্রতি ভোট কক্ষে একজন করে সহকারী প্রিজাইডিং এবং প্রতিটি ভোট কক্ষে দুইজন করে পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সব মিলিয়ে ৬ লাখের বেশি ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন।প্রতি কেন্দ্রে ১৫-১৮ জন নিরাপত্তা সদস্য। নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের নেতৃত্বে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কয়েক লাখ সদস্য।একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য বাজেট রয়েছে ৬৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনার চেয়ে আড়াই-তিনগুণ ব্যয় হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। ছবিসহ ভোটার তালিকার পর নবম সংসদ নির্বাচনে ৮ কোটি ১০ লাখ ও দশম সংসদ নির্বাচনে ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটার ছিলেন।