তাড়াহুড়া করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)চাপিয়ে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এটা নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হোক। বিমসটেক সম্মেলনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে আসার পর রোববার সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।গত শুক্রবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সাত দেশের জোট বিমসটেকের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলন থেকে দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তিনি আজ সংবাদ সম্মেলনে এলেন।
বিকেল চারটায় গণভবনে এই সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। শুরুতে বিমসটেক সম্মেলন নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে লিখিত বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই শুরু হয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের পালা।
প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপ বা যোগাযোগ করার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি ডাক দিচ্ছে, হুংকার দিচ্ছে ভালো। আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। তাতে বাধা দেওয়ার কিছু নেই।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর তো ওদের সঙ্গে কথা বলব না। তার (খালেদা জিয়া) যারা আমার বাড়িতে এসে বসে থাকত, তারা আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমার তো একটা আত্মসম্মান বোধ আছে। আমি বারবার অপমানিত হতে কেন যাব ?
বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে তো আমি গ্রেপ্তার করিনি। সে গ্রেপ্তার হয়েছে এতিমের টাকা চুরি করে। তাদের আমলে দুর্নীতি, ঘুষ নেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে।শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) যদি মুক্তি চান, কোর্টের মাধ্যমে আসতে হবে। দ্রুত চাইলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মামলা আমাদের সরকারের দেওয়া নয়। ওনারাই পছন্দের ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দীন সাহেবের আমলে দেওয়া।বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কোনো পদক্ষেপ তো নেবেনই না, তাদের সঙ্গে আর কখনও সংলাপে বসার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, “নির্বাচন হবে, এটা ঠেকানোর মতো শক্তি কারও নেই।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবির সঙ্গে দুর্নীতির মামলায় দ-িত তাদের দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তও যোগ করেছে। তারা সংলাপ ডাকতেও সরকারকে আহ্বান জানিয়ে আসছে।শনিবার ঢাকায় এক সমাবেশে বিএনপি নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং ভোটের তফসিল ঘোষণার আগে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না তারা।শেখ হাসিনাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি পাওয়া-না পাওয়া আদালতের বিষয় বলে এক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার নেই। খালেদা জিয়াকে আমি গ্রেপ্তার করিনি; রাজনৈতিকভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সে গ্রেপ্তার হয়েছে এতিমের টাকা চুরি করে। তারা আন্দোলন করুক। ডাক দিচ্ছে, হুঙ্কার দিচ্ছে খুব ভাল কথা। আবার বলছে নির্বাচন করবে না। কে নির্বাচন করবে-না করবে, সেটা সেই দলের সিদ্ধান্ত। এখানে আমাদের কী করার আছে?তাদের দল যদি মনে করে (নির্বাচন) করবে না, করবে না। যদি মনে করে করবে, করবে। এটা বিএনপির সিদ্ধান্ত, তারা কী করবে, না করবে। এখানে তো আমাদের বাধাও দেওয়ার কিছু নেই বা দাওয়াত দেওয়ারও কিছু নেই।
২০১৪ সালে খালেদা জিয়ার ছেলের মৃত্যুর পর সান্ত¡না জানাতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে আর কখনও কোনো আলোচনায় বসতে অনাগ্রহের কথা জানান শেখ হাসিনা।খালেদা জিয়ার ছেলে মারা যাওয়ার পর আমি গেলাম, আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে ঢুকতে দিল না। সেদিন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর তো ওদের সঙ্গে আমি অন্তত বসব না। আর কোনো আলোচনা হবে না। প্রশ্নই ওঠে না। আপনারা যে যাই বলেন। ক্ষমতাই থাকি, না থাকি, আমার কিচ্ছু আসে যায় না। শেখ হাসিনা বলেন, তখন তো গ্রেপ্তার করিনি। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারত। তখনই গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল। তখন আমি সহনশীলতা দেখিয়েছি।জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজার রায়ের পর গত ৮ ফেব্র“য়ারি থেকে খালেদা জিয়া কারাগারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মামলাটি আমরা দিইনি। আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাকে মুক্ত করতে হলে বিএনপির এত নামী-দামি আইনজীবী, ব্যরিস্টার, হোমড়া-চোমড়া সবাই, তারা কেন পারল না প্রমাণ করতে যে, খালেদা জিয়া নির্দোষ।তারা যেটা চাচ্ছে; খালেদা জিয়ার মুক্তি। তাদের তো কোর্টের মাধ্যমে আনতে হবে। আর যদি দ্রুত চায় তাহলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবে।১০ বছর ধরে দুর্নীতির মামলাটি চলার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যদি বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করতাম, করতে চাইতাম, তাহলে কি ১০ বছর লাগত?তাহলে এখানে আমাদের দোষ দিয়ে লাভটা কী?” মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। নেপালে অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা জানাতে রোববার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রধানমন্ত্রী এ কথা জানান।
বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গত বৃহস্পতিবার নেপলের কাঠমান্ডু যান শেখ হাসিনা। ওই দিন সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন তিনি। পর দিন যোগ দেন রিট্রিট সেশনে।সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি এবং ভুটানের সরকার প্রধান দাশো শেরিং ওয়াংচুকের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। সম্মেলন শেষে শুক্রবার তিনি ঢাকায় ফেরেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এবারের বিমসটেক সম্মেলনের নানা দিক তুলে ধরে বলেন, সার্বিক বিবেচনায় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন এবং এর অব্যবহিত পূর্বে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সভা বাংলাদেশের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নেপালের কাঠমুন্ডুতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে আমার অংশগ্রহণ এবং শীর্ষ সম্মেলনের পূর্বের সভাসমূহে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে।গত দশ বছরে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্যগুলো বিমসটেক সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় তুলে ধরার কথাও প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমসটেক অঞ্চলের দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত, সন্ত্রাসসহ অন্যান্য সমস্যাকে যৌথভাবে মোকাবেলা করার আহ্বান তিনি তার বক্তৃতায় জানিয়েছেন।সামষ্টিক উন্নয়নের জন্য মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সহায়তা, পুঁজি বিনিয়োগের উপরও জোর দিই এবং এ সকল প্রক্রিয়া জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল আইনি কাঠামো ও অন্যান্য আইনি দলিল দ্রুত সম্পন্ন করার উপর জোর দিই।
বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর বিদ্যুৎ গ্রিডের মধ্যে আন্তঃসংযোগ চালুর বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, এ চুক্তির মাধ্যমে বিমসটেক অঞ্চলে বিদ্যুৎ চলাচলের ক্ষেত্রে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে বলে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করি।সম্মেলনের সাইডলাইনে নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ভুটানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দাশো শেরিং ওয়াংচুকের এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার নানা দিকও সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলির সঙ্গে বৈঠককালে তিনি বাংলাদেশের প্রতি নেপালের ‘সুগভীর বন্ধুত্বের’ বিষয়টি তুলে ধরেন।আমি আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। বিবিআইএন-এর চলমান উদ্যোগের ব্যাপারে আমরা দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করি।আঞ্চলিক সহযোগিতার স্বার্থে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর নেপাল ও ভুটানকে ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাংলাদেশের রপ্তানির ব্যাপারে নেপাল আগ্রহের কথা জানান। নেপালের সঙ্গে সম্প্রতি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও বাংলাদেশে আমদানি বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য নেপালের সঙ্গে যৌথভাবে; ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ একসঙ্গে অথবা বাংলাদেশ নিজেই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বলে আমি তাকে অবহিত করেছি।ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বৈঠকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন বলে জানান শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যে কোনো দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য আদর্শ হতে পারে বলে তিনি (নরেন্দ্র মোদী) মন্তব্য করেন। তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।আমি বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, ভবিষ্যতে বিমসটেক একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে।বিকাল ৪টায় গণভবনে এই সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে জন্মষ্টমীর শুভেচ্ছা জানান এবং এরপর নেপালে বিমসটেক সম্মেলন নিয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন।লিখিত বক্তব্যের পর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।