বীজ ধানের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে ভেজাল মেয়াদ উত্তীর্ণ বীজ ধান বিক্রি করে দুই শ’ কৃষকের সর্বনাশ করে দেয়া হয়েছে। আমন মৌসুম নির্ভর কৃষকরা এসব বীজধানের চারা রোপন করে ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কৃষকের অভিযোগ, বিএডিসির সরবরাহ করা বীজ ধানের তীব্র সঙ্কটকে পুঁজি করে একটি প্রতারকচক্র কৃষকের এমন সর্বনাশ করে দেয়। এসব বীজ ধানের চারা রোপনের মাত্র ১৫দিনে কাইচ থোড় হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও শীষ বের হয়ে গেছে। শত শত একর জমি ফের চাষাবাদের কোন সুযোগও নেই। সময় পার হয়ে গেছে।পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলী ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন কৃষকরা। দিশেহারা কৃষক প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। বোরো মৌসুমের ব্রি ২৮ জাতের ধানের বীজের প্যাকেটে ব্রি ৪৯ জাত লিখে দেয়া হয়েছে। তাও ২০১৬ সালের পুরনো বীজ ধান বাজারে চালান করা হয়েছে।
আলীপুর বাজারের বিক্রেতা আমির শরীফ জানান, আলীপুর বাজারে হঠাৎ ব্রিধান ৪৯ এর চাহিদা বেড়ে যায়। স্থানীয় পরিবেশকের নিকট ধান না পেয়ে আমতলী উপজেলার কচুফাতরা এলাকার বিএডিসির পরিবেশক আবু মিয়ার মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স থেকে বীজধান সংগ্রহ করে বিক্রয় করেছেন। এ ধান তিনি নিজেও রোপন করেছেন। কৃষক হারুন মাতুব্বর, জলিল গাজী, এনায়েত হোসেন, জসিম উদ্দিনসহ অনেকে জানান, আলীপুরের ব্যবসায়ী চাঁনমিয়া বেপারী, আমির শরীফ, মাসুম বিল্লাহ, আবুল কালাম এদের দোকান থেকে বীজ কিনে ক্ষেতে রোপন করেছেন। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে অপরিপক্ক ধান গাছে ফলন এসে যায়। ফলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। যা চলতি মৌসুমে পূরণ করা সম্ভব হবে না। অভিযুক্ত ব্যবসায়ী চাঁন মিয়া বেপারী বলেন, এ এলাকায় হঠাৎ বীজের শঙ্কট দেখা দেয়। তখন আমি কচুফাতরার আবু মিয়ার থেকে বীজ সংগ্রহ করেছিলাম লতাচাপলী ইউনিয়নে রোপা আমন মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল বীজ ধানের চাহিদা রয়েছে পাঁচ হাজার ব্যাগ। বিএডিসি কর্তৃক সরবারহ করেছে ১৮শ’ ব্যাগ। বাজারে সঙ্কটের সুযোগে প্রতারকচক্র প্যাকেটে জাত পাল্টে দেয়। যেখানে দামও বেশি রাখা হয়েছে। এমনকি ২০১৬ সালের বীজ ধান ২০১৮ সালে বাজারে বিক্রি করা হয়। তখন ব্রি-২৮ জাতের বেরো মৌসুমের বীজধান বিক্রির দর ছিল কেজি ৩৬ টাকা। আর ওই বীজধান এ বছর জাত পাল্টে ২৮ কে ৪৯ লিখে ৬৩ টাকা কেজিতে বিক্রি করে। হাতিয়ে নেয় অতিরিক্ত লাখ লাখ টাকা। এভাবে অন্তত দুই শ’ চাষীর প্রায় তিন হাজার একর ক্ষেতের ফসল হানির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষকরা জানায়, একর প্রতি সাত হাজার এক শ’ টাকা খরচ হয়েছে বীজ ধান সংগ্রহে। চাষাবাদ ব্যয় হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। রোপন খরচ তিন হাজার টাকা। সার ও কীটনাশক খরচসহ মোট প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সব ঠিক থাকলে একর প্রতি ৫০ মন ধানের ফলন পাওয়ার কথা ছিল। যেখানে ৫০ হাজার টাকা বিক্রিমূল্য পেতেন। যেখানে কৃষকের অন্তত ৩৫ হাজার টাকা লাভ হওয়ার কথা। সেখানে উল্টো ১২ হাজার টাকার সঙ্গে আরও ৫০ হাজার টাকার ফলন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। শুধুমাত্র লতাচাপলী ইউনিয়নের দুই শতাধিক কৃষকের এমন সর্বনাশের খবর মিলেছে। যাতে অন্তত ১০ কোটি টাকার ক্ষতির কবলে পড়েছেন। সোমবার প্রতারিত কৃষকরা বিক্ষোভ সমাবেশ করলে কৃষিবিভাগ নড়েচড়ে বসে। একটি টিম মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনে নামে। লতাচাপলীর খাজুরা, মিশ্রিপাড়া, নয়া মিস্ত্রিপাড়া, মুসুল্লীয়াবাদ, মাইটভাংগা, তাহেরপুর, গোড়া আমখোলাপাড়া, দিয়ার আমখোলা গ্রামে মাঠ পর্যায়ে কৃষকের ক্ষেত পরিদর্শন করেন তাঁরা। ওই প্রতিনিধি টিমের সদস্য লতাচাপলী ইউনিয়ন উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আবুল কালাম জানান, এখানে ৩৫টি গ্রাম রয়েছে। সকল গ্রামের তথ্য এখনও নিতে পারেননি। তবে তার মতামত অন্তত ২০ ভাগ কৃষক কম-বেশি ক্ষতির কবলে পড়েছেন। কুয়াকাটা পৌর এলাকার দৃশ্যপট একই। খানাবাদ গ্রামের কৃষক ছালাম গাজী জানান, তিনি ছয় বিঘা জমিতে সাত শ’ পঞ্চাশ টাকা দরে তিন প্যাকেট বীজ ধান কিনে বীজতলা করেছেন। ২৫ আষাঢ় চারা রোপন করেছেন। মাত্র ২০ দিনে ওই গাছে ফলন ধরেছে। যা অপরিপক্ক। নতুন করে আর চাষের সময় নেই বলে ছালাম গাজীর দাবি। এমন অভিযোগ তুলাতলীর হারুন মাতুব্বর, সুলতান মাতুব্বরের।
অপরদিকে সোমবার বিক্ষোভকালে কৃষকরা আলীপুর বাজারের সার বীজ বিক্রেতাদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বীজধান বিক্রেতাদের সঙ্গে বুধবার সভা করেছেন। এসব খবরে কৃষি বিভাগ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্য কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা ক্ষেতে অতিরিক্ত সার ও কিটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেন। তবে অতিরিক্ত সার ও কিটনাশক বীজধান বিক্রেতারা আপাতত বাকিতে সরবরাহ করার শর্তে সন্ধ্যায় বন্ধ দোকানগুলো খুলে দেয়া হয়।কলাপাড়া উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল মান্নান জানান, মাঠ পর্যায় জরিপ চলমান রয়েছে। কৃষকরা নি¤œমানের বীজ বপণ করায় শুধু কৃষকের ক্ষতি হয়নি। দেশের ধানের উৎপাদনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ।