নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ওপরে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন কর্মরত সাংবাদিকরা। এ সময় তাঁরা আক্রমণকারী হেলমেটধারীদের আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার আলটিমেটাম দেন।যেখানে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করবে, সেখানে তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাহলে আপনাদের কাজ কী? নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামা আন্দোলনরত কোমলমতিদের সামাল দিতে পেরেছেন, সাংবাদিকদের সামাল দিতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার (৭ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত মানববন্ধনে এসব কথা বলেছেন সাংবাদিক নেতারা।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি আবু জাফর সূর্য বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দিতে। তাদের চিহ্নিত করা আমাদের কাজ নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে চাই, আপনার বাহিনির কাজ কী? সাংবাদিকরা আহত হলো, আপনাদের কেউ একবার তাদের দেখতেও গেলেন না। আমরা দল কানা নই, আমাদের চোখ আছে। তিন দিনের মধ্যে হামলাকারীদের চিহ্নিত না করলে, আর বিচারের আওতায় না আনলে আমাদের পথ আমরা বেছে নেবো।ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল, তখন তাদের অভিভাবকরা, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা, প্রিন্সিপালরা কোথায় ছিলেন? এই আন্দোলনে কীভাবে অছাত্ররা প্রবেশ করলো? বারবার সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হচ্ছে। এরপর সাংবাদিকরাও প্রয়োজনে লাঠি হাতে প্রতিহত করবে। আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাই। এছাড়া, সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে চাইÑ আপনারা যদি তথ্য যাচাই না করে সংবাদ পরিবেশন করেন, তার দায়িত্ব ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নেবে না।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন,‘আমরা ঢাকাসহ সারা দেশে আগামী ১১ আগস্ট বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবো। আমার ভাইকে রাস্তায় পেটানো হবে আর আপনারা নিরাপদে থাকবেন, তা হবে না। আমি সব স্তরের সাংবাদিকদের এই কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানাই।বিএফইউজে মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, প্রতিটি বিভাগে, প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি থানায় আন্দোলন দেখতে চাই। গুজব রটনাকারীরা আমাদের বিভ্রান্ত করছে। গুজবে কান দেবেন না। সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের যদি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা না হয়,তাহলে বিক্ষোভ কর্মসূচিসহ কঠোর আন্দোলন করবো আমরা।ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বলেন, যেকোনও পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। যেকোনও হামলা নির্যাতনের বিরুদ্ধেও সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে পারে। সাংবাদিকরা যখন ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে, তখন স্বার্থান্বেষী মহল হামলা চালাচ্ছে। সাংবাদিকরা তাদের গুজবকে খবরে পরিণত করেছে নাÑ এটাই তাদের ক্ষোভ। সাংবাদিকদের কাজ যারা বাধাগ্রস্ত করছে, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর যারা হামলা করে, তারা গুজবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের পেশাদারিত্বের জায়গা যারা বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারা সাংবাদিকদের শত্র“। দুঃখজনক হলেও সত্য হামলার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের ধরতে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি সরকারের পক্ষের কেউ আহতদের হাসপাতালে দেখতে যায়নি। সাংবাদিক নির্যাতনের বিচার করতে না পারলে আপনারাও আমাদের সমালোচনার পাত্র হবেন।ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, যেকোনও ন্যায্য আন্দোলনের সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীরা যুক্ত থাকেন। নিরাপদ সড়কের ন্যায্য আন্দোলনে দেখা গেছেÑ তৃতীয় পক্ষ ঢুকে গেছে। তারা সাংবাদিকদের বেছে বেছে হামলা করছে। সরকার, প্রশাসন ভালো করেই জানে এদের চিহ্নিত করা কোনও কঠিন কাজ নয়।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে এই কোমলমতি বাচ্চারা রাস্তায় নেমেছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের এই কর্মকান্ডের প্রশংসা করেছেন। তারা দেখিয়েছে কীভাবে চলতে পারে দেশ। কিন্তু এই আন্দোলনে ঢুকে পড়া এই তৃতীয় পক্ষ কারা? এই সরকার গণমাধ্যমবান্ধব, তাহলে সেখানে এরকম ঘটনা কেন ঘটছে?এসময় সাংবাদিকদের অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের উপস্থিত ছিলেনÑ বিএফইউজের সভাপতি মোল্লা জালাল, সহ-সভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাসহ নির্বাহী কমিটির অন্যান্য সদস্য এবং সাংবাদিকরা।অন্যদিকে,নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ওপরে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন কর্মরত সাংবাদিকরা। এ সময় তাঁরা আক্রমণকারী হেলমেটধারীদের আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার আলটিমেটাম দেন।মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারায় মানববন্ধন ও ১০ মিনিটের প্রতীকী কর্মবিরতি পালন শেষে সাংবাদিকরা এই আলটিমেটাম দেন।কয়েক দিন ধরে চলা নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় কর্মরত সাংবাদিকদের ওপর একের পর ক্রমাগত হামলা চালানো হয়। হামলাকারী সন্ত্রাসীরা পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েই সাংবাদিক বেছে বেছে এসব হামলা চালায়। স্পষ্ট ভিডিও এবং ছবি থাকার পরও কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, তা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।হামলায় আহত সারাবাংলা ডট নেটের সাংবাদিক উজ্জ্বল জিসান বলেন, ‘নিজে মাইর খাওয়ার পরে বুঝেছি এই হামলা কতটা ভয়াবহ। হামলাকারী এবং শিক্ষার্থীরা গালি দিয়ে বলে, এই মিডিয়ার দরকার নাই। সন্ত্রাসীরা যখন মারছিল, তখন শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে আসছিল কেউ কেউ। এভাবে হামলা হতে থাকলে মানসিক ও শারীরিক টর্চারের মধ্যে থাকতে হয়। পরিবারও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এসবের অবসান জরুরি।মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি পারভেজ খান বলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাব আছে। হামলাকারী সবাই চিহ্নিত। সরকার আন্তরিক হলে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব দ্রুতই।’ তিনি বলেন, ‘বিগত দিনে সাংবাদিকদের আন্দোলন থেকে এবারের আন্দোলনটা একেবারেই ভিন্ন। এবার কোনো দলীয় সাংবাদিকদের পক্ষে আন্দোলন হচ্ছে না। সব সময় আমরা এভাবে একই কাতারে দাঁড়াতে পারলে আমাদের আন্দোলনের সফলতা আসবে।
বাংলাদেশ ফেডারেশন সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএইউজে) কোষাধ্যক্ষ দীপ আজাদ বলেন, প্রশাসন উসকানিদাতার পরিচয় প্রকাশ করছে। কিন্তু সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের ফুটেজ তারা চাইছে। প্রশাসনের ইচ্ছে থাকলে তাদের কাছে যে ফুটেজ আছে, তাই দিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে পারবে ভালোভাবেই।
দীপ আজাদ আরো বলেন, সাংবাদিকরা আহত হলে সমাজের অন্য সবাই আহত হয়। অন্যদের সংবাদ প্রকাশ বন্ধ থাকে। ফলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।সাংবাদিক দীপন দেওয়ান বলেন, আমরা ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিচ্ছি সরকার এবং প্রশাসনকে। গুজবকারীদের যেমন শনাক্ত করা হয়েছে, তেমনি সাংবাদিকদের ওপরে কারা হামলা করেছে, তাদেরও খুঁজে বের করুন। ৭২ ঘণ্টার ভেতরে তাদের গ্রেপ্তার না করলে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।দীপু সারোয়ার বলেন, চলমান আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী, আন্দোলনবিরোধী এবং পুলিশ তিন পক্ষের কাছ থেকে সাংবাদিকরা হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়। সাংবাদিকরা কারো প্রতিপক্ষ নয়, তবুও কেন তাদের ওপর এমন হামলা। হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।মানববন্ধনে উপস্থিত আরো অনেকে জানান, এভাবে চলতে পারে না। এর সমাধান জরুরি। তাঁরা মাঠে শান্তিতে কাজ করতে চান। জীবনের শঙ্কা নিয়ে কাজ করতে চান না। এভাবে সাংবাদিকদের ওপরে আক্রমণ হতে থাকলে গণমাধ্যম আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাধারণ মানুষ সঠিক তথ্য পাবে না।মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান খান, একাত্তর টিভির নাদিয়া সারমিন, লাইজুল ইসলাম।