রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের রেলপথ নির্মাণের জন্য রেলের জমিতে দীর্ঘদিন যাবত বসবাসরত ভূমিহীন ও ছিন্নমূল মানুষ আপোষে তাদের স্থাপনা ও বাড়িঘর সরিয়ে নিয়ে নজির সৃষ্টি করছেন। রেলের জমিতে এগুলো অবৈধ স্থাপনা হলেও উচ্ছেদের ঘোষণা হলে সাধারণত প্রতিবাদে কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আন্দোলন করে থাকেন ক্ষতিগ্রস্থরা। কিন্তু ঈশ্বরদীর শত শত গরিব, ছিন্নমূল ও ভূমিহীন মানুষ কোনো আন্দোলন-সংগ্রাাম বা ক্ষতিপূরণের দাবি না করে উচ্ছেদের নোটিশ পেয়ে তাদের কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন। রোববার দুপুর পর্যন্ত স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত দেখা গেছে প্রায় দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে বসবাসরত ছিন্নমূল ও ভূমিহীন এই বৃহৎ জনগোষ্ঠিদের। গত ৪ দিন ধরে এসব স্থাপনা সরিয়ে নিচ্ছেন বলে তারা জানান।
ঈশ্বরদীর সাঁড়া গোপালপুর, পাতিবিল এলাকার বস্তির বাসিন্দারা বাড়িঘর সরিয়ে নেয়ার সময় এ প্রতিবেদককে জানান, রূপপুর প্রকল্প এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। আমাদের ঈশ্বরদীতেই এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের জন্য এখান দিয়ে যাবে নতুন রেলপথ। এক বছরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঈশ^রদীর রূপপুরে দুইবার এসেছেন। এটা ঈশ^রদীবাসীর জন্য সৌভাগ্য। দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে কষ্ট হলেও নীরবে আমরা সরে যাচ্ছি। এসব বাসিন্দরা আরো বলেন,আমরা স্বপ্ন দেখি রূপপুরের কারণে খুব অল্প সময়েই বদলে যাবে ঈশ্বরদীর চিত্র। সাঁড়া গোপালপুর বিলপাড়া এলাকার হতদরিদ্র চাঁদ আলী জানান, আমরা ভূমিহীন গরিব মানুষ। রেলের জমিতে ঘর তুলে ৩০ বছর ধরে বসবাস করছি। এখানে রূপপুর প্রকল্পে যাতায়াতের সুবিধার্থে রেললাইন করার জন্য আমাদের উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। নিজের কোনো জমি নেই। তবুও কোন উপায় নেই, এখান থেকে চলে যেতে হচ্ছে। মনে খুব কষ্ট নিয়ে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াচ্ছি।
রেলওয়ের ঈশ^রদী প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা (আই ডাব্লিউ) মাসুদ রানা জানান, কয়েক দিন আগে এই এলাকায় এসব অবৈধ বসবাসকারীদের মৌখিকভাবে স্থপনা ও বাড়িঘর সরিয়ে নেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। তবে উচ্ছেদের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তারা নিজ উদ্যোগে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। ক্ষতিপূরণের জন্য দাবী জানিয়ে কোন আন্দোলন বা প্রতিবাদ করার করার কথা আমি এখনও শুনতে পাইনি।
এ বিষয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) নাজমুল হোসেন জানান, রেললাইনের আশপাশে বসবাসকারীদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা তাদের বাড়িঘর ও স্থাপনা সরিয়ে না নিলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী উচ্ছেদ করা হবে। তবে শুনেছি তারা নিজেরাই দ্রুত সরিয়ে নিচ্ছে তাদের বাড়িঘর। রূপপুর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানান, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভারী যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সামগ্রী পরিবহনের জন্য প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করতে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন হতে সাঁড়া গোপালপুর পাইলট লাইন হয়ে ২২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ২২ কিলোমিটার রেলপথ ছাড়াও সাড়ে চার কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ হবে। প্রকল্পকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনার কার্যক্রম হিসেবে ঈশ্বরদী শহরের রেলগেট থেকে পাতিবিল, সাঁড়া গোপালপুর, সিবেল হাট, যুক্তিতলা-পাকশী হয়ে রূপপুর প্রকল্প পর্যন্ত স্থাপন করা হবে নতুন রেললাইন।
উল্লেখ্য, পারমাণিবক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সরকার সর্বশেষ লক্ষীকুন্ডা ও পাকশী ইউনিয়নের পদ্মা নদীর চরাঞ্চলের ৯৯৬ একর জমি কৃষকদের ফসলের ক্ষতিপূরণ প্রদানের আশ্বাস দিয়ে অধিগ্রহন করে। এরমধ্যে মাত্র ১৯ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন। অবশিষ্ঠ জমি সরকারের খাস খতিয়ানভূক্ত। এলাকার কৃষকরা এসব জমিতে চাষাবাদ করে পরিবারের ভরণ-পোষণ নিবৃত্ত করছিল। ৯৯৬ একর জমির অধীনে ৬৫০ জন কৃষকের নামে ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ টাকা বরাদ্দ করেছেন। কিন্তু রেলের এসব জমিতে বসবাসরত ভূমিহীন ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কোন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেনি। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করা হলেও হতদরিদ্র এইসব মানুষ ক্ষতিপূরণের জন্য কোন দাবী না জানিয়ে নিভৃতে তাদের বাড়িঘর সরিয়ে নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজে সহযোগিতা করে নজির সৃষ্টি করছেন।