প্রথমে ব্যাট হাতে ওপেনার তামিম ইকবালের অপরাজিত ১৩০ ও সাকিব আল হাসানের ৯৭ এবং পরে বল হাতে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার ৩৭ রানে ৪ উইকেট শিকারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয় দিয়ে ওয়ানডে সিরিজ শুরু করলো সফরকারী বাংলাদেশ। গায়ানায় গত রাতে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ৪৮ রানে হারিয়েছে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এই জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল মাশরাফির দল। গায়ানার মাঠ বাংলাদেশের জন্য পয়মন্ত। অতীত রেকর্ড তাই বলে। ২০০৭ বিশ্বকাপে সুপার এইটের ম্যাচে এই ভেন্যুতেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৬৭ রানে হারিয়েছিলো টাইগাররা। তাই সে স্মৃতি থেকে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেয়ার ভালো সুযোগ ছিলো সফরকারীদের। কিন্তু সফরে দু’টি টেস্টে যেভাবে বাংলাদেশ হেরেছে তাতে ওয়ানডে সিরিজের আগে চিন্তার ভাঁজটা গভীরই ছিলো বাংলাদেশের কপালে। তবে সেই ভাঁজ মুছে ফেলার পণ ছিলো অধিনায়ক মাশরাফির। টেস্ট সিরিজে ছিলেন না তবে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশকে সাফল্য এনে দেয়ার লক্ষ্য ছিলো মাশরাফির।
টস জিতে পরিকল্পনা মত প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্ত নেন মাশরাফি। অধিনায়কের সিদ্বান্তকে ভুল প্রমান করেন ওপেনার এনামুল হক। ৩ বল মোকাবেলা করে শুন্য হাতে বিদায় নেন তিনি। এর পর ইনিংসের দশম বলেই ক্রিজে আরেক ওপেনার তামিমের সঙ্গী হন সাকিব। গেল জানুয়ারিতে দেশের মাটিতে হয়ে যাওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকেই তিন নম্বরে ব্যাট করছেন সাকিব। এই সিরিজেও সেটির ব্যতিক্রম হলো না। কারন ঐ সিরিজে চার ইনিংসে দু’টি হাফ-সেঞ্চুরিতে ১৬৩ রান করেছিলেন সাকিব।
বন্ধু তামিমকে পেয়ে আরও বেশি উৎসাহি হয়ে উঠেন সাকিব। উজ্জীবিত ছিলেন তামিমও। তাই কাঁেধ কাঁধ রেখে বাংলাদেশের পালে রানের হাওয়া যুগিয়েছেন তারা। তবে রান তোলার গতি ছিলো একেবারেই মন্থর। তাই প্রথম পাওয়া প্লেতে বাংলাদেশের রান উঠে ১ উইকেটে ৩১ রান।
শতরানের কোটা স্পর্শ করতে ১৫৩ বল খেলতে হয় বাংলাদেশকে। ২০০ রানের কোটায় বাংলাদেশ পৌঁছায় ম্যাচের ২৫৬তম বলে। এসময় ৯০ রানের ঘরে দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরির প্রহর গুনছিলেন তামিম-সাকিব দ’ুজনই। তবে হতাশ করেছেন সাকিব। ওয়েস্ট ইন্ডিজের লেগ-স্পিনার দেবেন্দ্র বিশুকে সুইপ করে মারতে গিয়ে আকাশে বল তুলে দেন সাকিব। সেটি সহজেই স্কয়ার-লেগ থেকে দৌঁড়ে এসে লুফে নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের শিমরোন হেটমায়ার। ফলে ৯৭ রানে থামতে হয় দু’বার জীবন পাওয়া সাকিবকে। ১২১ বল মোকাবেলা করে ৬টি চার মারেন ১৮৬তম ম্যাচে ৩৮তম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেয়া সাকিব।
তামিমের সাথে দ্বিতীয় উইকেটে ২৫৮ বলে ২০৭ রানের জুটি গড়েন সাকিব। যা বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে এটি রেকর্ড। দ্বিতীয় উইকেট এর আগের সর্বোচ্চ রান ছিলো ১৬০। জুনায়েদ সিদ্দিকী ও ইমরুল কায়েস ২০১০ সালে ডাম্বুলায় করেছিলেন এ রেকর্ড। সাকিব হতাশ করলেও সেঞ্চুরির স্বাদ ঠিকই নিয়েছেন দু’বার জীবন পাওয়া তামিম। ১৮০ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দশম সেঞ্চুরি তুলে নেন তামিম। বাংলাদেশীদের মধ্যে সবচেয়ে ধীরলয়ে সেঞ্চুরির স্বাদ নিয়েছেন তামিম।
সাকিবের বিদায়ে উইকেটে গিয়ে কিছুই করতে পারেননি সাব্বির রহমান। ৩ রান করে থামেন তিনি। তবে আসল কাজটা করেছেন পাঁচ নম্বরে ব্যাট হাতে নামা মুশফিকুর রহিম। তামিমকে নিয়ে চতুর্থ উইকেটে ২০ বলে ৫৪ রান করেন মুশি। এরমধ্যে মুশফিকের অবদান ছিলো ১১ বলে ৩০ রান। তার ছোট্ট টর্নেডো ইনিংসে ৩টি চার ও ২টি ছক্কার মার ছিলো। শেষ বলে উইকেটে গিয়ে বাউন্ডারি হাকিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ২৭৯ রানে নিয়ে যান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। অন্যপ্রান্তে ১০টি চার ও ৩টি ছক্কায় ১৬০ বলে অপরাজিত ১৩০ রান করেন তামিম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেবেন্দ্র বিশু ৫২ রানে ২ উইকেট নেন।
জয়ের জন্য ২৮০ রানের লক্ষ্যে দেশেশুনেই শুরু করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই মারকুটে ওপেনার ক্রিস গেইল ও এভিন লুইস। শুরুতে বাংলাদেশের মাশরাফি ও মেহেদি হাসান মিরাজের বোলিং নৈপুন্যে ৮ ওভার শেষে ২৬ রান যোগ করতে পারেন গেইল-লুইস। নবম ওভারে লুইসকে থামিয়ে বাংলাদেশকে প্রথম সাফল্য এনে দেন মাশরাফি। ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ২৯ বলে ১৭ রান করেন লুইস।
দলীয় ২৭ রানে প্রথম উইকেট হারানোর কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিন নম্বরে নামা শাই হোপকে লেগ বিফোর ফাঁেদ ফেলেন বাংলাদেশের পেসার রুবেল হোসেন। ৪১ রানে ২ উইকেট হারানো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরবর্তীতে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যান গেইল ও হেটমায়ার। কিন্তু বেশি যেতে পারেননি তারা। নিজেদের ভুলে বিচ্ছিন্ন হন তারা। রান আউটের ফাঁেদ পড়ে ব্যক্তিগত ৪০ রানে থামেন গেইল। নিজের ৬০ বলের ইনিংসে ১টি চার ও ২টি ছক্কা মারেন গেইল।
এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডল-অর্ডারে দ্রুতই চার উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচের লাগাম নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। দলের কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান ৫২ রান করা হেটমায়ার ও সাত নম্বরে নামা রোভম্যান পাওয়েলকে শুন্য রানে বিদায় দেন।
অপরপ্রান্ত দিয়ে জেসন মোহাম্মদকে ১০ রানে মিরাজ ও স্বাগতিক অধিনায়ক জেসন হোল্ডারকে ১৭ রানে থামিয়ে দেন মাশরাফি। ফলে ৭ উইকেটে ১৫১ রানে পরিণত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ অবস্থায় ক্যারিবীয়দের আশা-ভরসা ছিলেন আন্দ্রে রাসেল।
১টি করে চার ও ছক্কায় উইকেট সেট হবার চেষ্টা করেছিলেন রাসেল। কিন্তু রাসেলকে আরও ভয়ংকর হবার সুযোগ দেননি বাংলাদেশ দলপতি ও দেশ সেরা পেসার মাশরাফি। ১২ বলে ১৩ রান করা রাসেলকে বিদায় দেন ম্যাশই।
রাসেলকে শিকারের পর আরও একটি উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি। ৭ রানে থাকা অ্যাশলে নার্স শিকার হন মাশরাফির। এতে ১৭২ রানে নবম উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
৪১তম ওভারের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নয় উইকেট তুলে নিলেও, শেষ পর্যন্ত তাদের অলআউট করতে পারেনি বাংলাদেশের বোলাররা। শেষ উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ৫৯ রান যোগ করেন বিশু ও আলজারি জোসেফ। দু’জনই ২৯ রান করে অপরাজিত থাকেন। শেষ পর্যন্ত ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৩১ রান করতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাশরাফি ১০ ওভারে ৩৭ রানে ৪ উইকেট নেন। এছাড়া মুস্তাফিজুর ৩৫ রানে ২, মিরাজ ৩৭ ও রুবেল ৫২ রানে ১ উইকেট নেন। ম্যাচ সেরা হয়েছেন বাংলাদেশের তামিম।
আগামী ২৬ জুলাই একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
বাংলাদেশ : ২৭৯/৪, ৫০ ওভার (তামিম ১৩০*, সাকিব ৯৭, মুশফিকুর ৩০, বিশু ২/৫২)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ২৩১/৯, ৫০ ওভার (হেটমায়ার ৫২, গেইল ৪০, মাশরাফি ৪/৩৭)।
ফল : বাংলাদেশ ৪৮ রানে জয়ী।
সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে বাংলাদেশ।
ম্যাচ সেরা : তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ)।