ভরা মৌসুম চলছে তারপরও জেলেদের জালে ধরা পড়ছেনা রূপালী ইলিশ। যে ক’টি পাওয়া যাচ্ছে তাও গত মৌসুমের তুলানায় অনেক কম। ফলে জেলে পরিবারে বিরাজ করছে হতাশা। পাশাপাশি মহাজনের দেনা পরিশোধ করতে না পেরে চরম উৎকণ্ঠায় জেলেরা।
জীবিকার তাগিদে জেলের সংখ্যা বাড়লেও বছর বছর কমছে আহরিত ইলিশের পরিমান। ঠিক উল্টো আবার চিত্র খরচের ক্ষেত্রে, খরচের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কিছুতেই।পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, বিচরণ ক্ষেত্রেগুলোতে চরজাগায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতকে ইলিশের পরিমান কমে যাওয়ার জন্য দায়ী করছেন জেলে, ইলিশের আড়ৎদার, মৎস্য অফিস, নদী বিশেষজ্ঞ এবং ইলিশ গবেষকরা।জেলা মৎস্য অফিসের গত ৩ বছরের ইলিশ আহরণের হিসাবেও দেখা গেছে একই চিত্র। এসব সংকট সত্ত্বেও বৃষ্টির পরিমান বাড়লে নদীতে ইলিশের বিচরণ বাড়বে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন নোয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মোতালেব হোসেন।অপরদিকে এখন জেলেরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদী ও সাগরে জাল ফেলছেন। কিন্তু তারা পুরো দিনে যে পরিমাণ মাছ পান তা বিক্রি করে প্রতিদিন ট্রলার ভাড়া তিন হাজার টাকা এবং জলদস্যুদের চাঁদা দিয়ে যা থাকে তা দিয়ে সংসারও চলে না।এর ওপর মহাজনের দেনার ভার মাথায় নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। কিন্তু হাল ছাড়েননি জেলেরা। প্রতিনিয়ত তারা জাল ফেলছেন এবং চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মাছ পাওয়ার জন্য।
নোয়াখালী জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ছোট ফেনী নদী ও বামনীয়া নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় ৮ হাজার পাঁচশ জেলে পরিবার। তারা নদীতে মাছ ধরে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের বেশির ভাগই মহাজন থেকে দাদন নিয়ে সংসার চালান। মৌসুমে তাদের মাছ দিয়ে দেনা মুক্ত হয়ে অবশিষ্ট মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে পুরো বছরের খরচ চালাতে হয়। আবার মহাজনরা তাদের থেকে দাদনের মাছ নিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে।এদিকে, ইলিশ সরবরাহ খুবই কম থাকায় জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে মাছের এখন অগ্নিমূল্য। জেলেরা জানান, প্রতি দিন ট্রলার ভাড়া তিন হাজার টাকা, বাহিনীর চাঁদা ট্রলারপ্রতি ৫০০ টাকা, কিন্তু নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতে যে মাছ পাওয়া যায় তা দিয়ে অনেক সময় ট্রলার ভাড়াও হয় না।জানা গেছে, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় মেঘনায় বহু ডুবোচর দেখা দিয়েছে। এতে ইলিশের বিচরণে বিঘœ ঘটায় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেকের ধারণা, সাগরে নি¤œচাপ সৃষ্টি হওয়ায় ইলিশ মাছ গভীর সাগরে চলে গেছে। ফলে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ২০ হাজার ২১২ মেঃটন ইলিশ আহরন হয়। বিগত হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় জেলের পরিমাণ বাড়লেও প্রতিবছরই কমছে ইলিশ আহরনের পরিমান। যেখানে ইলিশের পরিমাণ বাড়ার কথা সেখানে কমেছে।
নোয়াখালী উপকূলের সর্ববৃহৎ মাঝ ঘাট দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বয়ারচরের চেয়ারম্যান ঘাটে গিয়ে দেখা যায় নিষ্প্রাণ পড়ে আছে ইলিশের আড়ৎদারদের চৌকি। দু’/একটি নৌকা ঘাটে ভিড়লেই শুরু হয় হাঁকডাক। হাতিয়া উপকূলের ছোট বড় ৩০টির বেশী ঘাটে একই অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানান আড়ৎদাররা।হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে ইলিশ ধরে নদী থেকে ফেরা জলিল মাঝির মতে ‘আগে জিয়ানে মাছ ধইরতাম হিয়ানে ২০-৩০ হা হানি আছিলো, অন হিয়ানে হানি আছে ৮-১০ হাত’। সারাদিন রাত নদীতে থেকে ১০ পিজ ইলিশ মাছ পেয়েছে ইঙ্গিত করে মাঝ বয়সী এই জেলে জানান, গত বছরের এই সময়ে ২০-২৫পিজ ইলিশ পাওয়া যেতো।
এদিকে, নিঝুমদ্বীপের মৎস্য ব্যবসায়ী ইব্রাহীম পার্টি ও বাংলাবাজারের হেলাল উদ্দিন জানান, ইলিশ ধরার জন্য তাদের বেশ কয়েকটি ট্রলার নদীতে গিয়েও মাছ পাচ্ছে না। তাছাড়া জলদস্যুদের ভয়েও নদীতে নৌকা নামাতে সাহস পাওয়া যাচ্ছে না।নোয়াখালী উপকূলের জেলে, নৌকার মাঝি ও ইলিশের আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১২ইলিশ মাছ বেশী পানিতে বিচরণ করে। পলি জমে ক্রমাগতভাবে নদীর বুকে চর জেগে ওঠা এবং নদীর তলদেশের উচ্চতা বাড়ার কারণে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র এবং অভয়াশ্রমগুলোতেও পানির গভীরতা কমে যাচ্ছে। যারফলে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র এবং অভয়াশ্রমগুলোও ক্রমেই দক্ষিণে সরে যাচ্ছে। কিন্তু জেলেরাতো নিদিষ্ট স্থানেই ইলিশ শিকার করে থাকে। তাছাড়া সমুদ্রে মাছ আহরণের মতো সরঞ্জামও জেলেদের নেই। পাশাপাশি বৃষ্টি পাত কম হওয়ার কারণেও সাগর থেকে উপরের দিকে উঠছেনা ইলিশ মাছ। বৃষ্টি হলে এ অবস্থা কেটে যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেও সবাই স্বীকার করছেন বছর বছর কমছে আহরিত ইলিশের পরিমান। তবে; জেলেদের দাবি প্রকৃত্তি প্রদত্ত রূপালী ইলিশের আহরণ বাড়াতে দ্রুত সরকারি পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরী।
অন্যদিকে দ্বীপ উপকূলীয় হাতিয়ায় ইলিশের আড়ৎ নামে খ্যাত, নিঝুমদ্বীপ, তমরদ্দি, সোনাদিয়া, আসকাবাজার, মোকতাইরাঘাট, রহমতবাজার, সূর্যমূখী, কোরালিয়াঘাট, বাংলাবাজার, চেয়ারম্যানঘাট, রামচরণঘাট, নলচিরাঘাট, বৌবাজারঘাটসহ প্রধান প্রধান মৎস্যঘাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে মাছের অপেক্ষায় আছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া তারা বরফ ও মৎস্যজাত করণের অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে বসে আছেন আড়ৎদারেরা। দু’একটি নৌকায় দু’চারটি মাছ ধরা পড়লেও কোন কোন নৌকা আবার ফিরে আসছেন একেবালেই খালি হয়ে। নোয়াখালীর উপকূল ছাড়াও উপকূলের অন্যান্য অঞ্চলেও দেখা গেছে এমন চিত্র।নদীতে মৎস্য আহরণ বিষয়ে গবেষণা রয়েছে এমন একাধিক ব্যক্তি জানান, পলি পতন, পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাত কমে যাওযার কারণে ইলিশের চলাচল কমে গেছে একারণেই নোয়াখালী উপকূলে আপাতত ইলিশ কম ধরা পড়ছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানিতে তাপমাত্র বৃদ্ধি এবং লবনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণেও ইলিশ কম ধরা পড়ছে।হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটের হাতিয়া মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সূত্রে জানাযায়, হাতিয়ার চার পাশে মাছ ঘাট এবং কোল্ডষ্টোরঘাটসহ ৩০টির বেশী ঘাট রয়েছে। এসব ঘাট থেকে ৪-৫ হাজার নৌকা নদীতে নামে ইলিশ আহরণে। তন্মধ্যে চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ইলিশের মৌওসুমে প্রায় আড়াই হাজার নৌকা নেমেছে। এসকল জেলে/মাঝি-মাল্লা ভোলার দৌলত খাঁ, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, মুন্সিগঞ্জ, শ্রীপুর, ইলিশা, ফরিদপুর, শিবচর, ঢাকার ভাগ্যকূল ও হাতিয়া এলাকার।
নদীতে ইলিশ আহরণের পরিমান কমে যাওয়ার বিষয়ে জেলেদের মতামতের সাথে একাত্মতা পোষণ করে তিনি বলেন, বর্তমানে ইলিশের দাম চড়া। গড়ে প্রতি পন (৮০ পিজ) ইলিশের দাম ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা এবং বড় সাইজের ইলিশের পন ৭০-৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয় এখানে। তবে; ইলিশের দাম পেলেও কম ধরা পড়ার কারণে খরচ উঠানো কষ্টসাধ্য হয় অনেক সময়। তাছাড়া নদীতে ইলিশের আহরণ কম হলেও বছর বছর বাড়ছে জেলেদের সংখ্যা।জেলে সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নোয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মোতালেব হোসেন বলেন, নোয়াখালী উপকূলবর্তী চরগুলো বাসিন্দাদের প্রায় সবাই মাছ ধরার সাথে কোননা কোনোভাবে জড়িত। এঁরাই নদীতে নামছে ইলিশ আহরণে, জেলেদের সংখ্যা বাড়ার কারণেও জেলে প্রতি মাছ কম পাওয়ার কারণ হতে পারে। তিনি আশা করছেন আগামী মাসে জেলেরা প্রচুর পরিমাণ ইলিশ আহরণ করতে পারবে।