ঝড় বয়ে নিয়ে এসেছিল ফরাসি সৌরভ। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন হয়তো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন একগুচ্ছ গোলাপ আর টিউলিপ। ক্রেসতোভস্কি স্টেডিয়ামে দিদিয়ের দেশম জয়ের পর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। ডি ব্রুইন মানতে পারছিলেন না। লুকাকু অসহায় তাকিয়ে ছিলেন। এটাই ফুটবলের নিয়ম। বীরের মতো লড়াই করেছে বেলজিয়াম। খেলা শেষে জয়ী দলের নাম ফ্রান্স।
ঝড়ের কাছে গতির পরাজয় হয় কি? বোধহয় না! এই যুগে ফুটবলের ‘গতিরাজ’খ্যাত বেলজিয়াম ছন্দে ছিল। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের লড়াইটা সমানে-সমানে হয়েছে বলতেই হবে। নির্মম ফুটবলের নিয়ম সেটা মানে না। এক দলকে বিদায় নিতেই হবে; সেটাই হয়েছে। ফরাসি ফুটবলের জাদুকরী পারফরম্যান্সে বেলজিয়ান গতির পরাজয় ঘটেছে। রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে ফ্রান্স। ১-০ গোলের জয় নিয়ে ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ১৯৯৮ সালের চ্যাম্পিয়নরা।
এমবাপ্পের জাদু, লরিসের তিনটি দুর্দান্ত সেভ ও উমতিতির ওই একটি গোলেই ৯০ মিনিটব্যাপী চলা লড়াইয়ের ব্যবধান করে দেয়। ১২ বছর পর আবার শিরোপার সামনে ফরাসিরা। মারওয়ান ফেলেইনিকে ফাঁকি দিয়ে ম্যাচের ৫১ মিনিটে যখন স্যামুয়েল উমতিতি ফ্রান্সকে গোল এনে দিলেন। তখন গ্যালারিতে হাসছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী পামেলা অ্যান্ডারসন; ফ্রান্সের সমর্থক তিনি। ফরাসি ফুটবলার আদিল রামি তার বয়ফ্রেন্ড। এক ঝাঁক তরুণ ফুটবলার মাঠে লড়াই করছিল। গ্যালারিতেও বসেছিল তারার হাট। সব মিলিয়ে এই বিশ্বকাপ চমৎকার একটি সেমিফাইনাল ম্যাচ দেখেছে।
সেন্ট ডেনিস থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের দূরত্ব ২৭৫১ কিলোমিটার। আরেকটি হৃদয়ভাঙার গল্প দেখেনি বিশ্ব। ফরাসিরা চোখে জল এনেছিল। তবে এবার আনন্দের। কান্না-হাসিতে প্রাপ্তির জয়গান গেয়েছে স্যামুয়েল উমতিতির গোলের পর। কত প্রতীক্ষা, ২০০৬ সালের পর আবার ফাইনালে উঠল ফ্রান্স। ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপ ভুলে যেতেই হবে এখন। ৬৪ মিনিটে অবশ্য বেলজিয়ামের ফেলেইনি ক্রসে ভেসে আসা বল পেয়েছিলেন বক্সে; হেডও নিয়েছেন। বল এই দফায় জালে পৌঁছায়নি। অঁরি হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন। ফ্রেঞ্চ কোচ দিদিয়ের দেশমও এগিয়ে গেলেন। ১৯৯৮ সালে দুজনে ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন।
গতকাল প্রতিপক্ষ হয়ে হাত মেলালেন। অঁরি তো এখন বেলজিয়ামের সহকারী কোচ। অঁরির মুখে হাসি ছিল। দেশমের মুখ যেন পাথর দিয়ে তৈরি। মনে মনে হয়তো ভাবছিলেন, কী অঙ্ক কষে এসেছে কে জানে? বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল বলে চাপটা একটু বেশিই! দুদলই জটিল ফরমেশনে খেলা শুরু করে। গ্যালারিতে লাল ও নীলের সমারোহ, যেন নীল সাগরের বুকে কেউ লাল টিপ পরিয়ে দিয়েছে। গ্রিজম্যান সেন্টার করেন। প্রথমে দুদলই দম মেরে খেলছিল। মিনিট গড়াতেই দুদল খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে। একের পর এক আক্রমণ শুরু করে। কখনো ফ্রান্স, কখনো বেলজিয়াম। যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল। নেভা নদীর পাশে গতি আর ঝড়ের লড়াই হয়েছে।
প্রথমার্ধের প্রথম ১০ মিনিটে আক্রমণ আর জমাট ডিফেন্স। ১২ মিনিটে পগবা মাঝমাঠ থেকে দারুণ পাস দেন। এমবাপ্পে ছুটে গিয়েছিলেন। সে যাত্রায় বল কুর্তোয়ার হাতে। চার মিনিট পরেই হ্যাজার্ড ফাঁকা পেয়েছিলেন লরিসকে। শট নেন। তবে বারের বাইর দিয়ে যায় বল।
বাল্টিক সাগরের পাশে নয়। সেন্ট পিটার্সবার্গে ক্রেসতোভস্কি স্টেডিয়ামের পাসেই নেভা নদী। কুড়ি আঠারো বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ বলে কথা। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। দুদিন ধরে রোদের দেখা নেই। এমন ঐতিহাসিক ম্যাচের জন্য স্টেডিয়ামের প্রবেশমুখে চোখে পড়ে নদীতে বিশাল বিশাল জাহাজ দাঁড়িয়ে। অবশ্যই হেরে যাওয়া দলকে নিয়ে যেতে নয়! ঝড় ও গতির লড়াই দেখতে মাঠে হাজির ছিলেন স্বয়ং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফানটিনোর পাসে বসেছিলেন।
জাতীয় সংগীত বেজে উঠতেই উঠে দাঁড়ালেন। গ্যালারিতে উপস্থিত হাজারো দর্শকের সঙ্গে কোরাসে গাইলেন। এরপর হাসিমুখে দলকে শুভকামনা জানিয়ে বসলেন। মহারণের জন্য প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। জুসেও আগ্রহ নেই। খেলা শুরু হতেই জমে গেলেন যেন। এমন ম্যাচে প্রেসিডেন্ট কেন, পুরো বিশ্বই থেমে গিয়েছিল। ১৮ মিনিটে হ্যাজার্ডকে হতাশ করেন লরিস। তবে তিন মিনিট পর বেলজিয়ামের উইরেল্ড যে শটটি নিয়েছিলেন, লরিস ডান দিকে ঝাঁপিয়ে গোল ঠেকান। ফ্রান্স এ যাত্রায় বেঁচে যায়।
এর পর ফ্রান্সের আক্রমণ ঘন হতে থাকে। জিরু ও পাভার্ড দুটো সুযোগ পেয়েছিলেন। এমবাপ্পে দুটি চমৎকার সুযোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু জিরু কাজে লাগাতে পারেননি। প্রথমার্ধ শেষে গোলশূন্য থাকে ম্যাচ।
ফ্রান্সের সেন্ট ডেনিসে এই ১০ জুলাই ২০১৬ সালে পর্তুগালের কাছে ইউরো চ্যাম্পিয়নসশিপের ফাইনালে হেরেছিল ফ্রান্স। ১-০ ব্যবধানের হার। রোনালদো ইনজুরিতে ছিলেন। মাঠে নেমেও বের হয়ে যান। অতিরিক্ত সময়ে গোল দেন বদলি খেলোয়াড় এডার। সেবার ফরাসিদের মন ভেঙেছিল। এবার আর মন ভাঙেনি।