সাজানো গোছনো পরিবারের সদস্য তিনি। সবাই যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত জীবনে চললেও শুধূ পড়ে রইলেন শফিকুর রহমান। বয়স চলছে তিপ্পান্ন বছর। এখনও বিয়ে করেননি তিনি। চিকিৎসক দুই ভাই সহ ৪ ভাই ও দুই বোন সবাই ধনী। বাবা-মা’র চতুর্থ ছেলে শফিকুর রহমান ও বি,কম পাশ। শফিকুর রহমান গ্রামে মাত্র এক শতক জমির উপড় বাশের বেড়ার টিনসেডের ভাঙ্গাচোরা একটি ঘরে থাকেন তিনি। অমানবিক এ ঘটনাটি বেড়িয়ে আসে ঈদের পূর্বে বুধবার ‘মানবতায় আমর’ নওগাঁর মানব সেবা মূলক সংগঠনটির সদস্যরা দরিদ্রদের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরন করার সময় মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের চৌমাশিয়া গ্রামে থেকে। এসময় প্রথমেই শফিকুর রহমান এর হাতে একটি লুঙ্গি তুলে দেন সংগঠনের আইন বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম (নূর)। লুঙ্গি হাতে পাওয়ার পরই শফিকুর রহমান আবেগের বশে তখনই তার জীবন কাহিনী তুলে ধরেন ।
মৃত মহিউদ্দীন মুন্সির ছেলে শফিকুর রহমান বলেন, আমরা মোট ৬ ভাই ও ২ বোন। আমাদের বাবা বেঁচে থাকতেই সবার বড় ১ ও ২ নং ভাই দুজনেই লেখাপড়া শেষ করে ডাক্তারী পেশায় জরিয়ে পড়েন। এছাড়া অপর ২ ভাই ও লেখাপড়া করে বিভিন্ন পেশায় জরিয়ে পড়েন। আমার লেখাপড়া চলার মধ্যেই ২ বোনের ধনী পরিবারেই বিয়ে ও দেয়া হয়। এরই মধ্যেই আমার বাবা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। এছাড়া সামসুল আলম নামের আমার অপর এক ভাইও মৃত্যু বরন করেন। এরই মাঝে আমি বিকম পাশ করি।

জানাযায়, বড় ভাই ডাঃ নিজাম উদ্দীন বর্তমানে ঢাকা কেন্দীয় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দ্বায়িত্বরত আছেন। ছোট ডাঃ শোয়েব ও একজন চিকিৎসক। এছাড়া অপর ২ ভাই আখতার ফারুক ও আব্দুস সালাম প্রতিষ্ঠিত বড় ব্যবসায়ী। আমাদের দুই বোন সাদিকা সুলতানা ও উম্মে হাবিবাসহ জামাইরা ও ভাল অবস্থানে রয়েছেন। একবোন জামাইয়ের বগুড়ার সান্তাহারে পূর্বাশা নামের একটি সিনেমা হল রয়েছে। প্রশ্নের জবাবে শফিকুর বলেন, আমার এখানে এসে কোনও ভাই বা বোন খোঁজ-খবর নেয়না, তবে আমি তাদের কাছে গেলে আমাকে হাত খরচ দেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমি যেখানে আছি এখানে আমার ভাই ও বোনদেরও জায়গা আছে। আমি এখানে মাত্র এক শতক জমির মালিক বিধায় আমি এক শতকের উপর বাঁশের বেড়া ও বাঁশের চাটিয়ার দরজা বানিয়ে কোন রকমে বসবাস করছি।

বিয়ে না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নিজেই খেয়ে না খেয়ে জীবন-যাপন করছি বিয়ে করে বউ ও সন্তানদের কি খাওয়াব। এসময় শফিকুর রহমানের জীর্ন ঘড়ের ভেতর ঢোকার জন্য দরজায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের তৈরি নামমাত্র একটি দরজা। ঘরে সোজা হয়ে দাড়ানো যায়না। ঘড়ের ভেতর ছোট ছোট আকারে ইঁদুরের গর্তে ভরে আছে ঘড়। ইদুর মাটি তোলায় বাশের কাবাড়ির দরজাটি খোলা যায়নি। দরজা ঠেলে সামান্য যে ফাঁক হয়, সেইটুকু ফাঁক দিয়েই শফিকুর রহমান ভেতরে ঢোকেন ও বের হন। বাঁশের তৈরী ভাঙ্গা ঘড়টির বাইরে ঝোপ-জঙ্গল এ ভরা। ভাঙ্গা ঘড়ের ভেতরে উঁকি মেরে দেখা যায়, পোকা-মাকরের বাসা ও জঙ্গলে ভরা। সেই ঘড়েই বসবাস করছেন ধনী ভাই-বোনের র্নিজীব ভাই সাদামাটা মানুষ সংসারহীন দরীদ্র শফিকুর।

স্থানীয় মাসুদ রানা সহ কয়েকজন জানান, শফিকুর রহমান মনের কষ্ট চেপে রাখেন। কাউকে বা কারো কাছে তার কষ্টের কথা প্রকাশ করতে দেখেননি তাঁরা। প্রতিবেশীরা পালাক্রমে তাকে খাবার দিতে শুরু করলেও মাত্র ১৫/২০ দিনের মত খাবার খাওয়ার পর তিনি আর প্রতিবেশীদের দেয়া খাবার ও খান না। এমনকি পোকা-মাকরের বাসা বা ঘড়ে খেয়ে না খেয়েই বছরের পর বছর পার করছেন শফিকুর। গ্রামের মানুষের ব্যক্তিগত টিউবয়েলের পানি ও পান করেন না তিনি। নওগাঁ-মহাদেবপুর পাকা সড়কের ধনজইল মোড়ে থাকা সরকারী টিউবয়েলের এর পানি পান করছিলেন দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। একপর্যায়ে ওই টিউবয়েল নষ্ট হওয়ায় এখন পর্যন্ত চেরাগপুর ইউনিয়নের বাগধানা মোড়ে সরকারীভাবে স্থাপন করা টিউবয়েলের পানি প্রতিদিন বোতলে করে এনে রেখে সেই পানিই খেয়ে আসছেন ৩/৪ বছর ধরে।

তবে এলাকায় তাকে মাষ্টার হিসেবেই চেনেন বা মানেন। কারন পার্শ্বের বাগধানা হিন্দু পাড়া গ্রামের ৩ জন ছাত্রকে লেখাপড়া শেখান এবং সেখান থেকে যে সামান্য টাকা পান সেই টাকায় খাবার ও পড়নের কাপড় কিনেন বলেই জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা।
অপরদিকে শফিকুর রহমান এর জন্য বসবাসের উপোযোগি একটি ঘড় ও একটি টিউবয়েলের ব্যবস্থা করার দাবী জানান গ্রামবাসীরা। এসময় শফিকুর রহমান সম্মতিক্রমে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ নিজাম উদ্দীন এর বক্তব্য নেয়ার জন্য অফিসিয়াল ফোন নাম্বারে কল দিলেও রিসিভ না হওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।