বাংলাদেশ থেকে দশটি এজেন্সির মাধ্যমে যে প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি চলছিল তা স্থগিত করেছে দেশটির সরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত সুষ্ঠু তদন্ত না হচ্ছে, তত দিন ওই দেশের পরিচালিত পুরোনো পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হবে।প্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে একটি মানবপাচার চক্র মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে ওই এজেন্সিগুলোকে নিয়ে কাজ করছিল।
দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান শুক্রবার মালয়েশিয়াভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য স্টারকে বলেন, এই স্থগিতাদেশ তত দিন পর্যন্ত চলবে, যত দিন না বাংলাদেশের কর্মীদের মানব পাচারের যে পদ্ধতিতে নিপীড়ন চলছে-এমন অভিযোগের একটা পূর্ণ তদন্ত হচ্ছে।২০১৬ সালে মালয়েশিয়া যেতে নতুন পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের ১০টি এজেন্সিকে মালয়েশিয়া সরকার নির্ধারণ করে দেয় সে দেশে অভিবাসন শ্রমিক পাঠাতে। এর আগে বাংলাদেশ থেকে যেকোনো রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারত। এটি ছিল পুরোনো পদ্ধতি।বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর চলতি পদ্ধতিকে ‘পুরো জগাখিচুড়ি’ অভিযোগ করে এম কুলাসেগারান বলেন, কর্মী নেওয়ার পদ্ধতিটি একটা ব্যবসায় পরিণত করে ফেলেছে। তাতে কিছু মানুষের লাভ হচ্ছে। মালয়েশিয়া যেতে অভিবাসী কর্মীদের দুই দেশের মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশাল পরিমাণের গলাকাটা টাকা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশি যে ১০ এজেন্সি এই সংঘবদ্ধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত, তাও স্থগিত করা হলো।
এদিকে, মালয়েশিয়াভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য স্টার গতকাল এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে মানব পাচারের একটি সংঘবদ্ধ চক্র গত দুই বছরে প্রায় এক লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। এসব বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে ওই চক্রটি প্রায় ৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।২০১৬ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া এই পদ্ধতিতে এক লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। আরও এক লাখের বেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যেতে প্রত্যেককে স্থানীয় দালালদের ৪ লাখ ১৯ হাজার ৮৪৫ টাকা (মালেশিয়ান ২০ হাজার রিঙ্গিত) দিতে হয়। অভিবাসী কর্মীদের কাজের অনুমতিপত্র (ওয়ার্ক পারমিট) ও টিকিট বাবদ দালালেরা পুরো টাকার অর্ধেক পরিমাণ ‘সিন্ডিকেট চক্র’কে দিয়ে দেয়।অনুসন্ধানী ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর এই চক্রের হোতার নাম ‘ডাতুক সেরি’ (এর বাংলা মানে জনাব/সাহেব)।মালেশিয়ানদের কাছে এটি একটি সম্মানসূচক সম্বোধন। এই হোতাই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বিলিয়ন রিঙ্গিতের মানব পাচার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চক্রটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। মূল হোতা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ-দুই দেশেই শক্ত রাজনৈতিক প্রভাব আছে। ২০১৬ সালে এই ব্যবসায়ী দুই দেশের সরকারের এক চুক্তিতে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই চুক্তির ফলে মাত্র ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় অভিবাসী কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায়। এই চুক্তির ফলে প্রায় ১ হাজার ৫০০ রিক্রুটমেন্ট এজেন্ট মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
দ্য স্টার-এর প্রতিবেদনে উঠে আসে, ‘ওই ১০ এজেন্সির মধ্যে কয়েকটি এজেন্ট বাংলাদেশি কর্মী ও মালয়েশিয়ায় নিয়োগ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে শুধু টাকা আয় করতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের পাঠাচ্ছে। মালয়েশিয়া যেতে প্রত্যেক বাংলাদেশির কাছ থেকে নিবন্ধন থেকে পরিবহন বাবদ ২০ হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা) নেওয়া হচ্ছে। অথচ রিক্রুটিং এজেন্টদের মাথাপিছু খরচ হয় ২ হাজারের কম রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ৪২ হাজার ১৮১ টাকা)।ডাতুক সেরি এক মালয়েশিয়ান নারীকে বিয়ে করেছেন ১৫ বছর আগে। দ্য স্টার-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই টাকা নিয়ে ডাতুক সেরি, তাঁর সহযোগী ও বন্ধুরা আরও ধনী হচ্ছেন। এই টাকার একটা অংশ তিনি দুই দেশের রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভাগ করে দিচ্ছেন।