দেশের পাঁচ জেলায় বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জেলাগুলো হলো কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও মৌলভীবাজার। বন্যায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতিসহ যেকোনও ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে এই পাঁচ জেলা প্রশাসনকে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোল রুম থেকে এই জেলাগুলোসহ দেশের সব জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যাগাযোগ রাখা হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুম ইন চার্জ (উপ-সচিব) আব্দুল কাদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে,টানা বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে সিলেট অঞ্চলের চার নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে; এতে জেলার চার উপজেলায় বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।জানতে চাইলে আবদুল কাদের বলেন, বন্যাপ্রবণ পাঁচ জেলার প্রত্যন্ত-ঝুকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণকে সরিয়ে আনতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের দুই উপজেলাÑফটিকছড়ি ও রাউজানের বাসিন্দাদেরও সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। তাদের বন্যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছে। রাঙামাটির নানিয়ারচরে পাহাড়ধসে নিহতদের সাহাযার্থে জেলা প্রশাসনের তহবিল থেকে প্রতি পরিবারকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এছাড়া বন্যাকবলিতদের সাহাযার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।উপ-সচিব জানান, ইতোমধ্যেই জেলাগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল কলেজের রুমগুলো বসবাসের উপযোগী করে খোলা রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে।
এ দিকে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ জানিয়েছেন, জানমালের নিরাপত্তায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নানিয়ারচরে যেখানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে, সেটি অত্যন্ত দুর্গম এলাকা। আমি নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েও আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে সেখানে পৌঁছাতে না পেরে ফিরে এসেছি। তবে জেলার সর্বত্র স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। আশা করছি, আর কোনও দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছি।
এদিকে এ বছরও দেশের ৩৭টি জেলায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। অতি বৃষ্টি ও ভারী বৃষ্টির ফলে এ সব জেলায় বন্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। সপ্তাহের পাঁচদিনই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থার কর্মকর্তাদেও সঙ্গে বৈঠক করেছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ্ কামাল।গত ১ মে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসককের কাছে জরুরি বার্তা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে বন্যাসহ যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলায় সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। বন্যার সময় জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব জেলার ডিসির ত্রাণ ভা-ারে দুই লাখ টন চাল, নগদ ৫ লাখ টাকা ও দুই বান্ডিল ঢেউটিন দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বর্ষা মৌসুম আসার আগেই দেশব্যাপী ভারীবর্ষণ শুরু হয়েছে। অতিবর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও রয়েছে। গতবছর পাহাড়ধসে পার্বত্য অঞ্চলে ১৬৬ জন মারা গেছেন। অতিবর্ষণ-ভারী বর্ষণে এ বছরও পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই পাঁচ জেলায় জরুরি সভা করে যেকোনও পরিস্থিতিতে জরুরি করণীয় নির্ধারণ করেছেন। এ বছরের বৃষ্টিপাতের প্রবণতা স্বাভাবিক নয় বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ কারণে অধিক বৃষ্টিবহুল এলাকার জেলা প্রশাসকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয সূত্র জানিয়েছে, অতি বর্ষণ ও ভারী বর্ষণের সঙ্গে রয়েছে অতিরিক্ত শিলা বৃষ্টি। আগে বৃষ্টির সঙ্গে মার্বেল সাইজের শিলা বর্ষিত হলেও এ বছর বড় আকারের শিলাও বর্ষিত হয়েছে। এতে টিনের ঘরের চাল ছিদ্র হয়ে মানুষের গায়ে পড়েছে। এতে মানুষ আহত হওয়ার সংবাদও পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে নতুন করে দুর্যোগ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। আবহমান কাল ধরেই বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বর্তমানে বজ্রপাতের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বংলাদেশে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনাও।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, বজ্রপাত, ভারী বর্ষণ ও অতিবর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যাসহ যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে প্রতি জেলার ডিসিকে ২০০ টন চাল ও পাঁচ লাখ নগদ টাকাসহ দুইশ’ বান্ডিল ঢেউ টিন আপদকালীন মুজদ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এ সব জেলার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ভবনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যা হলে বা পরিস্থিতি খারাপ হলে বন্যা দুর্গতরা যেন সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। যেকোনও ধরনের দুর্যোগের জন্য আমারা আগাম প্রস্তুমি নিয়ে রেখেছি। এবার যেন একজন মানুষও মারা না যায়, এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ।ত্রাণমন্ত্রী বলেন, আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস পাওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে আমরা আগাম প্রস্ততি নিয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি শেষ। প্রস্তুতি কাজে তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী ও নৌ বাহিনীকেও প্রস্তুত থাকলে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব শাহ্ কামাল বলেছেন,বংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে দুই লাখ রোহিঙ্গা পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে আছে। এ কারণে তাদের কুতুপালং ও বালুখালীর মাঝখানে একটি নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হচ্ছে। ৫০ হাজার পরিবারের এই ২ লাখ সদস্যের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের একলাখ রোহিঙ্গাকে ইতোমধ্যেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ বাকিদেরও সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
টানা বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে সিলেট অঞ্চলের চার নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে; এতে জেলার চার উপজেলায় বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে জেলার কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। আর সারি ও পিয়াইন নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তুাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল।সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ২ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার ও সিলেটে পয়েন্টে দশমিক ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।অন্যদিকে কুশিয়ারার পানি অমলসিদ পয়েন্টে ১ দশমিক ৪৯ সেন্টিমিটার ও শেওলা পয়েন্টে দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।পানি ঢুকে পড়ায় এ চার উপজেলার রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা; পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব অঞ্চলের অন্তত ২০ হাজার মানুষ।
প্রকৌশলী সিরাজুল জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং, আলীরগাঁও, রুস্তমপুর, ডৌবাড়ী, লেঙ্গুড়া,তোয়াকুল ও নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরে পানি উঠেছে।জৈন্তুপুর উপজেলার নিজপাট, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার ডুলটিরপাড়, বিরাখাই, শেওলারটুক, আসামপাড়া এলাকায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা।
কানাইঘাটে সুরমা নদীর উপচে পানি প্রবেশ করেছে কানাইঘাট উপজেলা সদরে। দক্ষিণ ও পূর্ববাজারের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া কানাইঘাট পৌরসভার বায়ুমপুর ও রামপুর গ্রামের বেশকিছু এলাকায় প্রবেশ করেছে বন্যার পানি।জকিগঞ্জ উপজেলায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী অন্তত দশটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।এদিকে প্রবল বৃষ্টিতে সিলেট নগরের নিচু এলাকায়ও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। নগরীর সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর এলাকায় বেশ কিছু বাড়ি ঘরে পানি উঠেছে।সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দেবজিৎ সিংহ বলেন, প্রকৃতিগতভাবে সিলেটে পাহাড়ি ঢল নামলে নদীর পানি বেড়ে গিয়ে জনপদ প্লাবিত হয়। নতুন করে ঢল না নামলে পানি আবার নেমে যায়।পানি বাড়া অব্যাহত থাকলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে; কিন্তু এখনও বন্যা দেখা দেয়নি।প্লাবিত গ্রামগুলোতে সরকারি সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।