পার্বত্য অঞ্চল আমসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফলের অন্যতম বড় উৎপাদন ক্ষেত্র। গত দুই দশকে পাহাড়ে আম চাষে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ব্যক্তিগত চাহিদা মিটিয়ে আম এখানকার অন্যতম বাণিজ্যিক ফল। জুমের ঐতিহ্যগত চাষাবাদ পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে আমসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ফল। দেশজুড়ে প্রায় সত্তর জাতে ফলের চাষ হয়। যার বেশীর ভাগই পাহাড়ে চাষযোগ্য। উৎপাদন বিবেচনায় আম বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফল। বিশ্বব্যাপী আম উৎপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম । ২০১৬ সালে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ ১১ হাজার ১১২ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়েছে। স্বাদ,গন্ধ ও সুদর্শন হওয়ায় আমকে বলা হয় ফলের রাজা।
আম উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় আক্রমনকারী পোকা মাকড়। বিশেষত মাছি পোকার আক্রমণের কারণে আমের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়। এর ফলে আমের ফলন প্রায় ৪০-৭০ শতাংশ হ্রাস পায়। পোকার হাত থেকে আম রক্ষার জন্য চাষীরা একাধিক কীটনাশক বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তবে ব্যবহার পদ্ধতি তুলনামূলক সহজতর হওয়ায় চাষীরা কীটনাশকের নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আমের জীবন প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৫-৬২ বার বালাইনাশক ব্যবহার করে। কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে বাড়ে কৃষকের উৎপাদন খরচ। এছাড়া কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব মানবদেহ ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যার দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল মানুষকেই বহন করতে হয়।তবে ফসলে কীটনাশকের পরিবর্তে নয়া প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে আইপিএম আইএল,বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সাইট কিংবা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীরা। যা ‘ফুড ব্যাগিং’ নামেই পরিচতি। ফুড ব্যাগিং এদিকে আমের সুরক্ষা নিশ্চিত করে অন্যদিকে পরিবেশের উপর নেতিবাচক কোন প্রভাব ফেলবে না। কৃষকদের মাঝে দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে ‘ফুড ব্যাগিং’। এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে,‘ মাছি পোকা ডিপটোর বর্গের অর্ন্তগত পরিবারের একটি বহুভোজী প্রকৃতির পোকা। এরা আম ছাড়াও বরই,কমল,কামরঙা,সফেদা,জামরুলসহ একাধিক ফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বৃষ্টি বহুল ও পাহাড়ি অঞ্চলে জুন থেকে জুলাই মাসে এই পোকার আক্রমন বেশি। তবে শীতে আক্রমনের তীব্রতা কম । ল্যাংড়া,খিরসাপাতি এবং ফজলী আমের এরা বেশি আমক্রণ করে। ফল পাকার ছয় থেকে সাত সপ্তাহ আগে এই পোকার আক্রমণ শুরু হয়। আমের যে স্থানে ডিম পাড়ে তাতে আমে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জন্মে এবং এক পর্যায়ে আক্রান্ত আম পঁচে ঝরে পড়ে।
ফুড ব্যাগিং পদ্ধতিতে কাপড়,পলিথিন ও কাগজ দিয়ে ফলকে একটি নিদিষ্ট সময়ব্যাপী ঢেকে রাখা হয়। পৃথিবীব্যাপী এটি পরিচিত পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহারকাল এক দশকের বেশি না। তুলনামূলক ফুড ব্যাগিং ব্যয়বহুল হওয়ায় কৃষক পর্যায়ে এর বিপুল ব্যবহার এখনো শুরু হয়নি। এই পদ্ধতি ব্রাউন পেপার,মার্কিন কাপড় এমনটি পলিথিন ব্যাগিংও করা যায়। তবে রপ্তানি ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের জন্য ব্রাউন ব্যাগিং পদ্ধতি সবচেয়ে বেশী উপযোগী। তবে একাধিক মৌসুমে ব্রাউন পেপার ব্যবহার সুবিধা থাকায় উৎপাদন খরচ অনেকটা কমে যায়। বাদুর,পাখি,কাঠবিড়ালীর আক্রমণ থেকে আম রক্ষা করা যায়। ব্যাগিংকৃত আমের সাইজ বড় হয় এবং এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ পরিবেশ সম্মত। তবে পুরনো বাব ড় গাছের আমে ব্যাগিং পদ্ধতি অসুবিধাজনক । আমের পরিপক্কতা আসার প্রায় ৪০-৪৫ দিন পূর্বে আমের ব্যাগিং করতে হয়। রৌদ্রোজ্বল আবহাওয়ায় ব্যাগিং করতে হয়। অতীতে ব্যাগের জন্য বিদেশ থেকে আমদানির উপর নির্ভরশীল হলেও বর্তমানে বাংলাদেশেও এর উৎপাদন হচেছ ।খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণার মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী আব্দুর রশীদ বলেন,‘ আমে নির্বিচারে কীটনাশক দেওয়ার কারণে প্রকৃতি ও প্রাণের সহায়ক অনেক উপকারী পোকা মাকড় মারা যাচ্ছে। অতিমাত্রায় কীটনাশক হওয়ার কারণে পরিবেশ ও মানব দেহে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফুড ব্যাগিং একটি জনপ্রিয় আমের পোকা দমন পদ্ধতি । বাণিজ্যিক আম বাগানে এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।