কক্সবাজারের ক্যাম্পে বসবাসরত লাখ লাখ রোহিঙ্গা আসন্ন বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। দেশি-বেদেশি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী,ভূমি ধস ও বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে দেড় লাখ রোহিঙ্গা।তবে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের পশ্চিমে সাড়ে ৫০০ একর এলাকাকে নিরাপদ বসতি উপযোগী করে গেড়ে তোলার কাজ চলছে। এরই মধ্যে ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছে প্রশাসন।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন থেকে বাঁচতে গত বছরের আগস্ট থেকে বাংলাদেশে আসা সাত লাখসহ কক্সবাজারে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন প্রায় ১১ লাখ।টেকনাফ ও উখিয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত এ সব রোহিঙ্গার উৎকণ্ঠা আসন্ন বর্ষা মৌসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ায় তাদের পরিণতি কী হবে? যারা পাহাড়ের খাঁড়া ঢালে ঘর তুলেছেন তাদের রয়েছে ভূমিধসের ভয়। আর নিম্নাঞ্চলে যারা থাকছেন তাঁরা উদ্বিগ্ন বন্যায় প্লাবিত হওয়া নিয়ে।কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী, যাদের একজন পঞ্চাশোর্ধ আরেকজন কিশোর এনটিভিকে বলেন,বর্ষায় একটু বাতাস হলেই তো পাহাড়ের ওপরের ঘর উড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটু বাতাস এসেই পরিবারের লোকজনের মনে ভয় দেখা দেয়। আর সামান্য বৃষ্টি এলেই তো ঘরে পানি পড়ে। পানি জমলে ঘর বৃষ্টির পানিতে ভেসে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় শিবির গড়ে তোলার কাজ হচ্ছে বিদেশি সহায়তায়। ক্যাম্পে এ ঝুঁকির কারণে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে কী পরিস্থিতি হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও।ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায়, কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের ৫৫ ভাগ এলাকাই ভূমিধসপ্রবণ। ২০১৭ সালের মে মাসে সেখানকার ৪৮টি স্থানে ভূমিধস হয়।
অপরদিকে ইউএনডিপি ও পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় ঘূর্ণিঝড় মোরার মতো কোনো ঝড় আঘাত হানলে সেখানকার ৭০ শতাংশ রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ইমার্জেন্সি কো-অর্ডিনেটর ম্যানুয়েল কারকুয়েস বলেন, আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে এসব মানুষকে নিরাপদ রাখা। আমরা এটা নিশ্চিত করার জন্যই সরকারের সঙ্গে কাজ করছি।জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হেড অব অপারেশন কেভিন জে অ্যালেন এ ব্যাপারে বলেন, সামনের বর্ষা মৌসুমে ভূমিধস থেকে রোহিঙ্গাদের বাঁচানোই প্রধান কাজ।রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিরাপদ রাখতে সরকার আন্তরিক বলে জানান,এই কর্মকর্তা।উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নিকারুজ্জামান বলেন, পাহাড়ের সেই ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরিয়ে রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সাইড ম্যানেজমেন্টের কাজ এখন চলছে। আমরা প্রায় এক লাখ লোককে সরিয়ে নেব। এখন পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি লোককে কিন্তু সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বিপর্যয় ঠেকাতে যে তৎপরতা চলছে তা সার্বিক সংকটের তুলনায় সামান্য।
এদিকে, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে হাতিয়া উপজেলার ভাসান চরে স্থানান্তর করা হবে।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল এই কথা জানান।তিনি বলেন, মায়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় নেয়া এক লাখ নাগরিকের জন্য আবাসন সুবিধাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির কাজ চলছে। আগামী আগস্টের মধ্যে অবকাঠামোর কাজ শেষ করে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তাদেরকে ভাসান চরে স্থানান্তর করা হবে। বর্তমানে নিবন্ধিত ১১ লাখ ১৭ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিকের মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজারের বেশি মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থান করছেন বলে তিনি জানান।কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, শনিবার উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুর্যোগকালীন করনীয় বিষয়ে এক মহড়ার প্রশিক্ষণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ত্রাণ সচিব শাহ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, দুর্যোগকালে কিভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হয় তা শিখানোর জন্য এ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নাগরিকদেরও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।দমকল বাহিনীর উদ্যোগে এই মহড়া অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, হাতিয়া উপজেলার মূল ভূখন্ড থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে মেঘনা নদীপথ পার হলেই ভাসান চরের অবস্থান। বর্তমানে ওই চরটির আয়তন প্রায় ১৩ হাজার একরের বেশি। এছাড়া দ্বীপটির চতুর্দিকে প্রতি বছর গড়ে ৩৫/৪০ বর্গকিলোমিটার ভূমি জেগে উঠছে বলে এলাকাবাসী জানান।ভাসান চরের পূর্বদিকে সন্দ্বীপ উপজেলা। হাতিয়া মূল ভূখন্ড থেকে ট্রলারযোগে ভাসান চর যেতে সময় লাগে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা। কয়েক বছর আগে স্থানীয় বন বিভাগ এখানে বনায়ন শুরু করে। ফলে ভাসান চরে বিভিন্ন অংশে গাছ-গাছালিতে ভরে গেছে।এই চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের পদক্ষেপ হিসেবে চরের চতুর্দিকে বেঁড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এছাড়া সড়ক ও অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজ চলছে হবে। আগামী দুই বছরে এখানে ১০ লাখ রোহিঙ্গা পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়।