তুমুল হট্টগোলের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে দুদক, রাষ্ট্রপক্ষ ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের শুনানি বুধবার শেষ হয়েছে।প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ এই শুনানি গ্রহণ করে আগামী মঙ্গলবার (১৫ মে) আদেশের জন্য দিন ঠিক করেছেন।এর সকালে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন ও মওদুদ আহমদ খালেদা জিয়ার জামিনের সপক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। তাঁদের যুক্তিতর্ক শেষ হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম খান মঙ্গলবারের মতো আজও জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।
খুরশিদ আলম খান আদালতকে বলেন,দুদকের স্থায়ী কোনো প্রসিকিউশন নেই। দুদক তাঁদের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়।যে মামলা পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, শুধু সেই মামলাই তাঁরা পরিচালনা করেন। মামলায় সাজা হলে মামলার সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত থাকে।এর সঙ্গে রাষ্ট্রও জড়িত। জরিমানা আদায়সহ নানা বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের ভূমিকা থাকে।এ সময় আদালত দুদক আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, আপনি একটা কেস দেখান যে হাইকোর্ট কোনো মামলায় জামিন দিয়েছিলেন, সেখানে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেছিলেন কি না। এ ছাড়া আদালত তাঁর কাছে আরও জানতে চান, এই মামলার প্রধান আসামি কে? খুরশিদ আলম তখন আদালতকে জানান, এখানে বিচারিক আদালত ভুল করেছে। যে কারণে আমরা হাইকোর্টে রিভিশন করেছি।এরপর বেলা একটার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর বক্তব্য শুরু করেন।
এই মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অংশগ্রহণ নিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিভিন্ন বক্তব্যের প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, তিনি ২০০৯ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।তিনি রাষ্ট্রপক্ষে প্রথম যে মামলাটিতে অংশ নিয়েছিলেন, সেটি ছিল মানি লন্ডারিং আইনের একটি মামলা। এ ছাড়া এই মামলাতেই বিচারিক আদালতের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে আসলে সেখানেও অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এর বাইরেও উচ্চ আদালতের মামলার রেফারেন্স তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে যে অংশ নিয়েছিলেন, সেই কথাও জানান মাহবুবে আলম।পরে বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের দেওয়া যুক্তি খনমবন করতে দাঁড়িয়ে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, হাই কের্টের দেওয়া জামিন আপিল বিভাগে বহাল থাকবে। জামিনে হস্তক্ষেপ করে আপিল বিভাগ ব্যতিক্রম কোনো নজির সৃষ্টি করবে না।পরে যুক্তি খনমবন করতে এসে খুরশীদ আলম খান হাই কোর্টে খালেদা জিয়ার মূল আপিল শুনানির নির্দেশনা চেয়ে জামিন বাতিলের আবেদন জানান।
আর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, খালেদা জিয়ার যেসব অসুস্থতার যুক্তি দেখিয়ে তার আইনজীবীরা জামিন চাইছেন, সেসব সমস্যা বিএনপিনেত্রীর আগেও ছিল। তা নিয়েই তিনি রাজনীতি করে আসছিলেন। সুতরাং সেটা সহনীয় পর্যায়ের। এখন তাকে জামিন দিলে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।আপিলের পেপরাবুক যেহেতু তৈরি হয়েছে, তার জামিন বাতিল করে আপিল শুনানি শুরু করা প্রয়োজন। এ সময় প্রধান বিচারপতি তাঁকে বলেন, আমরা তো আপনাকে অ্যাডমিট করেছি। বেঞ্চের অপর একজন বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দারও অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন,বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে যেকোনো মামলায় আপনি অংশ নিতে পারেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় টাকা কীভাবে এসেছিল, সেই টাকা নিয়ে কীভাবে দুর্নীতি হয়েছে এবং খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিরা কীভাবে অভিযুক্তÑবিচারিক আদালতের নথিপত্র থেকে এই তথ্য তুলে ধরতে থাকেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল যখন কথা বলছিলেন, তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বাধা দিতে থাকেন, বিএনপিপন্থী কিছু আইনজীবী হইচই করতে থাকেন। সে সময় অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, টাকা কীভাবে চলে গেছে, সেটা তো আমাকে বলতে হবে। সে সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহবুব উদ্দীন খোকনও জোরে কথা বলতে থাকেন, আইনজীবীরাও চিৎকার করতে থাকেন।
পরে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, এভাবে হইচই করলে কোর্ট চালাতে পারব না।তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী জয়নুল আবেদীনসহ অন্য আইনজীবীদের চিৎকার করতে বারণ করেন। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে তাঁর যুক্তিতর্ক তুলে ধরতে বলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতিকে বলেন, এমন পরিবেশে কীভাবে সাবমিশন রাখব। এরপর হইচই বন্ধ হলে অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, মওদুদ আহমদ ও এ জে মোহাম্মদ আলীর দেওয়া যুক্তিতর্ক খন্ডন করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, খালেদা জিয়ার যে রোগের কথা বলা হচ্ছে, সেই রোগ নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। এই রোগ নিয়েই তিনি সবকিছু করছেন। এটা সহনীয়। এই কারণে খালেদা জিয়ার জামিন হতে পারে না।এর পরপরই প্রধান বিচারপতি আগামী মঙ্গলবার আদেশের জন্য দিন ধার্য করে এজলাস ত্যাগ করেন।
এর আগে খালেদা জিয়ার জামিনের গুরুত্ব তুলে ধরে তাঁর আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার অবস্থা গুরুতর। জেলখানায় চিকিৎসা হচ্ছে না। আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছি। তাঁর হাত ফুলে উঠেছে। ঘাড় নাড়াতে পারছেন না। কথাও বলতে পারছেন না। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, খালেদা জিয়া বিশ্রামে আছেন। মানুষের জন্য আদালত, আদালত সবকিছুই দেখবেন।তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৩ বছর। আদালতের চোখ আছে, মন আছে, বিবেক আছে। পাবলিক পারসেপশন আছে। এই কোর্ট ছাড়া আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।
এ সময় জয়নুল আবেদীন খালেদা জিয়ার জামিনের সপক্ষে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। জয়নুল আবেদীন অভিযোগ করেন, অনেক মামলায় জামিন হয়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তো আপিল করে না।এ সময় তিনি সরকারদলীয় দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মামলায় জামিন ও খালাসের বিরুদ্ধে দুদকের আপিল না করার বিষয়টি আদালতের কাছে তুলে ধরেন।
সকালে শুনানির শুরুতে জয়নুল আবেদীন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল এই মামলায় কোন অথোরিটি নিয়ে শুনানিতে অংশ নিয়েছেন? তখন আদালত তাঁর উদ্দেশে বলেন, আপনারাই তো রাষ্ট্রপক্ষকে সংযুক্ত করেছেন। সে সময় জয়নুল আবেদীন বলেন, দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ যখন এক হয়, তখন ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে আমাদের সংশয় দেখা দিয়েছে।তিনি আদালতকে আরও বলেন, লঘু দন্ডের যেসব মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত সাধারণত হস্তক্ষেপ করেন না।
এ ছাড়া খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন তাঁর শুনানির শুরুতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি আদালতের কাছে দাবি করেন, ১/১১ সরকারের সময় এই মামলা শুরু হয়েছিল। এ সময় তিনি পত্রিকার খবর পড়ে আদালতকে বলেন, এখন সারা দেশে নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে। অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের ওপর দায় দিয়ে অশুভ পাঁয়তারা করছেন।
আদালতের উদ্দেশে খন্দকার মাহবুব বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ করছি, হাইকোর্ট কোনো মামলায় জামিন দিলে আপিল বিভাগ সেখানে হস্তক্ষেপ করেন না। করার নজির নেই। তখন প্রধান বিচারপতি তাঁর উদ্দেশে বলেন, যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিলেও আমরা তা আটকে দিয়েছি।
খন্দকার মাহবুব বলেন,খালেদা জিয়া সম্পূর্ণ নির্দোষ। এই মামলা-সংশ্লিষ্ট কোনো কাগজপত্রে তাঁর কোনো স্বাক্ষর নেই। এই মামলা যখন শুরু হয়েছিল, তখন ছিল মাইনাস টু ফর্মুলা। আর এখন ফর্মুলা মাইনাস ওয়ান।
দিনের শুরুতে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, হাইকোর্টে কোনো মামলায় জামিন হলে উচ্চ আদালত সাধারণত সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করেন না। বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, তিনি কোনো পার্টির অ্যাটর্নি জেনারেল না।
এই মামলায় বিচারিক আদালত তাঁর রায়ে কিছু ভুল করেছেন বলে দাবি করেন এ জে মোহাম্মদ আলী। আদালতের উদ্দেশে এ জে মোহাম্মদ আলী সম্প্রতি পুলিশের হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনার কথা তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মধ্যে জমিরউদ্দিন সরকার ও সানউল্লাহ মিয়াও উপস্থিত আছেন শুনানিতে। এছাড়া বিএনপি নেতাদের মধ্যে ছিলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান।এই দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্র“য়ারি পাঁচ বছরের সাজার রায়ের পর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করে জামিন পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আপিল বিভাগ তা স্থগিত করে দিলে খালেদার মুক্তি আটকে যায়।হাই কোর্টে আপিল চলমান থাকা অবস্থায় ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ জামিন পাবেন কি না- তা এখন আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে।
অবশ্য জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন হলেও অন্য মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তার মুক্তি বিলম্বিত করার কৌশল’ সরকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে বিএনপি নেতাদের মধ্যে।খালেদা জিয়া পরিত্যক্ত ওই কারাগারে থেকে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন দাবি করে তাকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার দাবিও তারা জানিয়ে আসছেন।
বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই।রমনা থানায় দুদকের করা এই মামলার বিচার চলে পুরো দশ বছর। ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্র“য়ারি এ মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়ার পাশাপাশি তার ছেলে তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদকে দশ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দেন।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর মামলার নথি নিম্ন আদালত থেকে এনে তা দেখে গত ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে সর্বোচ্চ আদালত গত ১৪ মার্চ জামিন স্থগিত করে নিয়মিত আলিভ টু আপিল করতে বলে। এরপর ১৯ মার্চ দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের অনুমতি দিয়ে ৮ মে শুনানির দিন ঠিক করে দেয় আপিল বিভাগ। ফলে খালেদার জামিন স্থগিতই থাকে।