ভোটের তারিখের মাত্র নয়দিন আগে সীমানা জটিলতা নিয়ে এক রিট আবেদনে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে হাই কোর্ট।বিচারপতি নাঈমা হায়দার এবং বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চ রোববার রুলসহ এই আদেশ দেয়।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৫ মে এই সিটির ভোট করতে সব প্রস্তুতি চলছিল। প্রধান দুটি দলসহ সব দলের প্রার্থীরাই পুরোদমে প্রচারও চালাচ্ছিলেন।এই অবস্থায় আদালতের স্থগিতাদেশ আসার পর নির্বাচনের সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখতে গাজীপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।নির্বাচন কমিশন এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাবে কি না- তাৎক্ষণিকভাবে সে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি ইসি কর্মকর্তারা।উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সব ধরনের নির্বাচনী কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি হাতে পাওয়ার পর ইসি পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে।রোববার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁও নিজ কার্যালয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, টেলিভিশনে তাঁরা দেখেছেন হাইকোর্ট গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। তবে ইসি এখনো এ আদেশের কোনো কপি পায়নি। যেহেতু ইসি হাইকোর্টের আদেশের বিষয়টি জানতে পেরেছে, তাই নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এ নির্দেশনা দিয়েছেন, ইসির কোনো আইনজীবী সেখানে ছিলেন কি না, সেসব বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানেন না। তবে হাইকোর্টের পরবর্তী নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।উল্লেখ্য, ১৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। সেভাবেই নির্বাচনী কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছিল।ঢাকার সাভারের এক নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ২০১৫ সালে এক নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবিএম আজহারুল ইসলাম সুরুজ ওই মৌজাগুলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন থেকে বাদ দিতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেন।
কিন্তু এ ব্যাপারে ইসির সাড়া না পেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশন যেন তার আবেদনের নিষ্পত্তি করে- সেই আর্জি জানানো হয় তার রিটে।হাই কোর্ট তখন নির্বাচন কমিশনকে তার আবেদনটি নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়ে আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দেয়।কিন্তু নির্বাচন কমিশন ওই বিষয়টি অনিষ্পন্ন রেখেই গত ৪ মার্চ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করে এবং ৩ এপ্রিল তফসিল ঘোষণা করে।এ প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের গেজেট, ৪ মার্চের গেজেট এবং ৩ এপ্রিলের তফসিল চ্যালেঞ্জ করে রোববার হাই কোর্টে রিট করেন আজহারুল ইসলাম।তার আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার তিন মাসের জন্য ভোট স্থগিত করে দেয়। সেইসঙ্গে দুই গেজেট এবং তফসিল কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত।
ইসি এখন কী করবে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, মহামান্য হাই কোর্ট গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। কী কারণে এই নির্বাচন বন্ধ হয়েছে, সেটি স্থানীয় সরকার বিভাগের ভুল, নাকি কমিশনের ভুল- সেসব এখনও জানতে না পারলেও আদালতের নির্দেশনার প্রতি সম্মান রেখে নির্বাচনের সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশন সচিব খুলনায় রয়েছেন। তারা ঢাকায় ফিরলে কমিশনের বৈঠকে বসবে। সেখানেই পরবর্তী করনীয় ঠিক হবে।
এদিকে, বেলা পৌনে তিনটার দিকে খবর এল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এই খবরে হঠাৎ করেই থেমে গেল গাজীপুরবাসী। সবার মধ্যে হতাশা আর প্রশ্ন, যাঁরা লাখ লাখ টাকা মাঠে খরচ করে ফেলেছেন, তাঁদের কী হবে?অন্যদিনের মতোই রোববার সকাল থেকেই মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রতীক নিয়ে বেড়িয়ে যান ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। কেউ পথসভা দিয়ে শুরু করেন কেউ বা উঠান বৈঠক দিয়ে প্রচার শুরু করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম রোববার সকালে ম্যাট্রিক্স সোয়েটার করখানায় পোশাকমালিকদের সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই ও বিকেএমইএর নেতারা উপস্থিত থেকে তাঁকে সমর্থন দেন। পরে সেখান থেকে তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী এলাকায় কয়েকটি কারখানায় শ্রমিকদের কাছে ভোট চাইতে যান।একই সময়ে বিএনপি দলীয় প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার তাঁর নিজ বাড়িতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া টঙ্গীর কয়েকটি ওয়ার্ডে নির্বাচনের প্রচারে যান।ঠিক বেলা পৌনে তিনটার দিকে বিভিন্ন অনলাইন ও টেলিভিশনে খবর প্রচার হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এই খবরে পুরো গাজীপুরে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো গাজীপুর শহর ও নগরের বাসিন্দাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখর পরিবেশ থেমে যায়। সবার মধ্যে দেখা দেয় হতাশা।হাইকোর্টে মামলা করেন শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম সরুজ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাজীপুরের ছয়টি মৌজার আংশিক শিমুলিয়া ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দাদের ভোটে তিনি দুবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এলাকার সীমানা রক্ষা করতে নিরুপায় হয়ে মামলাটি করা হয়েছে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, সীমানা নিয়ে যে জটিলতা ছিল, সেগুলো মীমাংসা করার পরই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করে। মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি বিস্তারিত জানতে ঢাকায় যাচ্ছেন। তবে নির্বাচন স্থগিত করায় প্রার্থীরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।গাজীপুরের সীমান্তবর্তী পশ্চিম পানিশাইল গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান,আমরা কখনোই শিমুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলাম না। কিন্তু ওই চেয়ারম্যান আমাদের জোর করেই তাঁর এলাকার বাসিন্দা করতে চাচ্ছেন। আমরা গ্রামবাসী প্রয়োজনে আন্দোলনে যাব, তবে সাভার উপজেলায় যাব না।