রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির হিসাবে, প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে কমপক্ষে ৬৪টি তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। সংগঠনটি বলছে, সড়কের এসব দুর্ঘটনা আসলে দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা, উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সভায় আরও বক্তব্য দেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়রম্যান কাজী রিয়াজুল হক, ডিটিসিএ’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া, বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
বৈঠকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেন, সড়ক খাতে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি মুহূর্তে জনগণকে জীবন দিতে হচ্ছে। নারী, প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের জন্য পরিবহনে কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। কিছু প্রভাবশালীর কারণে এ খাতে শৃঙ্খলা থাকছে না। নৈরাজ্য কমাতে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে।তিনি মনে করেন, পরিবহন খাতে নৈরাজ্য বন্ধে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।সভার শুরুতে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাতে বলা হয়, সমিতির সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে কমপক্ষে ৬৪টি তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। প্রতিদিন পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ। মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কের অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য পরিবেশে যাত্রীদের যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো চাঁদাবাজি, জরিমানা আদায় ও অর্থ আত্মসাতের মহোৎসবে মেতে উঠেছে।
পরিবহন খাত একক কর্তৃপক্ষের অধীনে না আনলে অব্যবস্থাপনা বন্ধ হবে না বলে মনে করেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সরকারের কোনো সংস্থা পরিবহন খাতের দায়িত্ব নিতে চায় না। রাজধানীসহ সারাদেশের গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছে বলে উল্লেখ করে আলোচনাসভায় বক্তারা এসব নৈরাজ্যের নানা দিক তুলে ধরেন।
এসবের মধ্যে রয়েছে: বাসে-বাসে রেষারেষি করে বেপরোয়া চলাচল ও পাল্লা-পাল্লির যত্রতত্র বাস থামানো, চলন্ত অবস্থায় মাঝপথে গতি কমিয়ে বাসে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, রাস্তার মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ংকর প্রতিযোগিতা এবং নানাবিধ অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা। ঢাকার গণপরিবহনের নিত্যদিনের চিত্র এটা। সারাদেশেই চিত্রটা মোটামুটি একই। বক্তারা বলেন, এসব কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা। সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুটি বাসের মাঝখানে হাত চাপা পড়ে সরকারী তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের। এতে তাকে প্রথমে হাত হারাতে এবং পরে জীবনও হারাতে হয়। রাজীবের মৃত্যুর এই মর্মান্তিক ঘটনায় সারাদেশ গুমরে কাঁদলেও বেপরোয়া চালকরা নির্বিকার। প্রতিদিনই বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কে ঝরছে গড়ে কমপক্ষে ৬৪ টি তাজা প্রাণ। প্রতিদিন আহত ও পঙ্গুর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০ জনের বেশি মানুষ। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা, সড়কের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লক্ষ যানবাহন রাস্তায় চলছে। এসবের ৭২ শতাংশ ফিটনেসহীন। চলাচলের প্রায় অযোগ্য। অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখ চালকের হাতে। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। ফলে এসব বাসের দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্যমতে, সারাদেশে জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত ১৭৭৯ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১,৮৪১ জনের প্রাণহানি হয়েছে এবং ৫,৪৭৭ জন আহত হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন ২৮৮ জন।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি আরো বলছে, বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তথাকথিত সনাতন পদ্ধতিতে জরিমানা আদায়েই ব্যস্ত। ট্রাফিক পুলিশ পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে চাঁদাবাজি, টোকেনবাজী, জরিমানা আদায় ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়াতেই বেশি ব্যস্ত। প্রকৃত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে কোনঠাসা করে ক্ষমতাবানদের লেজুরবৃত্তি করে এমন গুটিকয় সংগঠন এই সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিপরীত কাজে লিপ্ত। তারা চাঁদাবাজি, পারমিট বাণিজ্য, কর্তৃত্ব জাহির, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত রয়েছে। রাজনৈতিক ঠিকাদারেরা সরকারের আপন লোক সেজে সড়কে শত শত কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নেয়। পরে যেন-তেনভাবে কাজ করে বিল নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। অথবা রাস্তা কেটে মাসের পর মাস ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। এহেন পরিস্থিতিতে সড়কে নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি ও দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা এসব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয় পরিকল্পিত হত্যাকা- বলতে চাই। কেননা আমাদের সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে আমাদের যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। দৈনিক চুক্তিভিক্তিক ইজারায় প্রত্যেক মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এতেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। এহেন পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নিচে কে পড়লো বা কার হাত বা পা গেল তা দেখার সময় নেই চালকদের।রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং পথে পথে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি ১০টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। এগুলো হচ্ছে: নগরীতে বাসে-বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধে একই রঙের কালারের কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করা, উন্নত বিশ্বের আদলে আমলাতন্ত্রের বাইরে গিয়ে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে ‘গণপরিবহন সার্ভিস অথরিটি’ নামে একটি টিম গঠন করা (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত এই টিম নগরজুড়ে গণপরিবহনের সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে প্রতিদিনের সমস্যা প্রতিদিন সমাধান করে নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থা একটি শৃংখলায় নিয়ে আসবেন এবং সড়কের সুষ্টু ব্যবহার নিশ্চিত করবেন), গণপরিবহনের মান, যাত্রীসেবার মান, বাস টার্মিনালের পরিবেশ, যাত্রী ও গণপরিবহন সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধান করা, ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ ও অনান্য সেবাদান প্রতিষ্ঠানসমূহ এই টিমের নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে, এই ধরনের একটি টিম জরুরি ভিত্তিতে গঠন করা, ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনা, চালকের হাতে দৈনিক জমাভিত্তিক বাস ইজারা দেওয়া বন্ধ করা, বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা জনবান্ধব করা, এই আদালত পরিচালনার মাধ্যমে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, ট্রাফিক পুলিশের মামলার জরিমানা সরাসরি ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করা, সড়কে চাঁদাবাজি, টোকেন-বাণিজ্য, দখলবাজি, হকার ও অন্যদের ব্যবহার বন্ধ করা, রুট পারমিট ইস্যু প্রক্রিয়ায় ঢাকা মেট্রো আরটিসিতে মালিক-শ্রমিক নেতাদের পরিবর্তে পেশাদার ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকজন নিয়ে পূর্ণগঠন করা, ভাড়া-নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া এবং পরিবহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যাত্রী সাধারণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরা ও মত প্রকাশের স্বার্থে যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি কায়েমী স্বার্থরক্ষার জন্য এই সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন সেক্টরের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উপায়ও বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে সরকারের কাছে দিয়েছেন। তারপরও সরকার বছরের পর বছর এইসব সমস্যার সমাধান না করে এই সমস্যাকে পুঁজি করে নানা ধরনের পায়দাতন্ত্র হাসিল করতে চায়।বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, মাদকের হাত থেকে পরিবহন সেক্টরকে রক্ষা করা না গেলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়তে থাকবে। তিনি অনতিবিলম্বে নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া আইন না মানার প্রবণতাকে সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, যারা নিহত হন শুধু তারাই মারা যান না, এক অর্থে তার পুরো পরিবারটি মারা যায়। কেননা ঐ পরিবারের পরিচালক যখন মারা যায় তখন পরিবারটির আর অস্তিত্ব বলে খিচু আর থাকে না।