বর্তমান বিশ্বে চলছে চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং গোটা বিশ্বের শিল্পকারখানা, প্রযুক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এখন আজীবন চাকরি বলে কিছু নেই, চাকরি আছে ততদিন যতদিন কাজ আছে এবং কাজ আছে ততদিন যতদিন ডিমান্ড আছে । শেয়ার মার্কেট নির্ধারণ করছে বর্তমান কর্মসংস্থান। শেয়ার হোল্ডার, রাজনীতি, ক্লাইমেট পরিস্থিতি, এসব বিশাল আকারে প্রভাব বিস্তার করছে শিল্প কারখানা এবং অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে। শিক্ষা ও শিক্ষার মান নির্ভর করছে গ্লোবাল চাহিদার উপর এবং তাও হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লেভেলে। শেয়ার বাজার নির্ধারণ করছে চাকরি থাকবে কি থাকবে না। সেক্ষেত্রে নিশ্চিত বলা কঠিন কী পড়লে সারাজীবন চাকরির গ্যারান্টি মিলবে। তবে সারা জীবন টেকসই ইন্ডাস্ট্রি প্রভাইডার এবং যোগ্য নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে হলে দরকার সময়োপযোগী সুশিক্ষা । যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে সময় ও প্রয়োজনের সীমারেখা়। অগ্রণী চিন্তায় আমার পৃথিবী উদ্ভাসিত হবে আমার জ্ঞানের আলোকে! এই শিক্ষা হবে আমার উপার্জনের হাতিয়ার। বাংলাদেশ উন্নয়নের সড়কে উর্দ্ধমুখী এক দেশ। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও সময়ের স্রোতে এ দেশের সব সেক্টরেই লেগেছে আজ ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। কিন্তু আমাদের ধ্যানে-জ্ঞানে এ ছোঁয়া আজও লাগেনি!!!
চাহিদা বলছে কী পড়তে হবে এবং কেন পড়তে হবে। এ সময়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে এবং প্রত্যেকটি শিক্ষককে জানতে হবে চাহিদাগুলো কী এবং তার জন্য কী করা দরকার। ছাত্রছাত্রীরা নকল করছে, এ নিয়ে জাতি হতাশ। তাদের নকল করার পিছনে জড়িত রয়েছে হাজারো কারণ— নিম্ন মানের অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা, অসচেতন অভিভাবক, প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক, দুর্নীতি, ধর্ম, রাজনীতির প্রভাব এবং কর্ম সংস্থানের অনিশ্চয়তা। যখন চাহিদার সাথে সঙ্গতিহীন ও সমন্বয়হীন শিক্ষা চালু রয়েছে তখন মেধার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা, মুখস্থবিদ্যা বা লৌকিকতার ওপর তখনই জাতি অরাজকতা এবং অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
নিজে কী চাই সেটার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে অন্যে কী চায় তার ওপর নজর বেশি বিধায় যেকোনো মূল্যে পাশ করতে হবে, এমন ধরনের “মাইন্ডসেট” তৈরি হচ্ছে। ফলে সর্বত্র নকল করার প্রবণতা বাড়ছে। নকল আজীবন ছিল এখনও রয়েছে। এটা শুধু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা রয়েছে সর্বত্র, সব শ্রেণির মধ্যে এবং সারাবিশ্বে। মনে হয় বাবা-মা যা করতে ব্যর্থ হয়েছে সেটা দেখতে চায় তাঁর সন্তানের মাঝে আর তা করতে যেকোনো মূল্যে সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজি। দুঃখের বিষয় সবাই ভুলে যাচ্ছে যে, তারা যে নোংরামি জমা করছে তা পরক্ষণেই ফিরে আসছে আরো দুর্গন্ধ হয়ে। সারাবিশ্ব যেখানে একে অপরের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে কেনাবেঁচার মধ্য দিয়ে, এমন একটি সময় বাংলাদেশ হতে চলছে নিঃসঙ্গ। কারণ তারা যা তৈরি করছে তা দেশের বাইরে বিক্রি করা যাচ্ছে না। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে– মাছ, শাকসব্জিসহ নানা খাবারে মেশানো হচ্ছে ফরমালিনের মতো এক বিষাক্ত কেমিক্যাল যার কারণে বিদেশে তা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। সারাদেশে দুর্নীতি, ঘুষ, অবিচার দেদারসে চলছে। ছেলেমেয়ে যখন জানছে বাবার মাসিক বেতন ২০,০০০ টাকা অথচ ছেলেমেয়ের টিউশন ফি ১০,০০০ টাকা, বাড়িভাড়া ১০,০০০ টাকা, বাজার খরচসহ অন্যান্য খরচ ২০,০০০ টাকা, তখন নকল করা কি সমাজের চোখে অন্যায়????। মনুষ্যত্বের যখন মৃত্যু ঘটে তখন এমনটি হিসাব নিকাশের গড়মিল হওয়াটা জাতির জন্য একটি কঠিন কাজ বলে আমি মনে করি না। it’s like shit in shit out, it’s not unexpected it’s an expected outcome. এ দুরাবস্থার সময় স্বাভাবিকভাবেই ধর্ম প্রভাব বিস্তার করছে ভয়ংকর আকারে। কারণ ধর্মের আড়ালে সবকিছু লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এটাই যদি সত্যি হয় তাহলে কী করে জাতি ফরমালিন থেকে শুরু করে দুর্নীতি, ঘুষ, নকল এসব থেকে মুক্ত থাকতে পারে?
নকলকে নিয়ে যেভাবে আলোচনা তৈরি হচ্ছে তেমন করে উপরের অন্য বিষয়গুলো নিয়ে তেমন আলোচনা বা ডিবেট হচ্ছে না! ছেলেমেয়েদের নৈতিক মূল্যবোধ দিনে দিনে অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে যার ফলে নকল করা বা অপরাধ করা তেমন বিবেকহীন কাজ বলে নতুন প্রজন্মের কাছে মনে হচ্ছে না। এরূপ চিন্তাও তাদের মাথায় নেই। জনৈক বাংলাদেশী নকলের অভিশাপ থেকে জাতীকে রক্ষার উপায় আমার কাছে জানতে চেয়েছেন।যতোটুকু বুঝি ততোটুকু এখানে তুলে ধরলাম।তাড়াহুড়ো করে, পড়াশুনোয় ফাঁকি দিয়ে এবং নকল করে পাশ করে বেকার থাকার চেয়ে ভালো হবে পড়াশুনো করে সুশিক্ষাটা অর্জন করে দেশে না হলেও অগত্যা বিদেশে চাকরির সুযোগটা গ্রহণ করার চেষ্টা করা। সেইক্ষেত্রে শেখার জন্য পড়াটা ভবিষ্যতের অন্ধকারকে আলোতে পরিণত করতে সাহায্য করবে। “নকল” is a easy, effective and very creative way to find some short terms solution if no one can catch you.
প্রতিফলনটি আমি মনে করি এমনটি হতে পারে। প্রশ্ন এমনভাবে করা উচিত যাতে ১টা প্রশ্ন করলে কমপক্ষে ৩ বা তার অধিক উত্তর হয়। আর সে উত্তর যদি তারা না জানে তাহলে নকল করতে গেলেও অংকের সমীকরণের মতো ভুল হবে, যদি সমীকরণের নীতি, পদ্ধতি না জানা থাকে। শিক্ষা ও মনুষ্যত্বকে একসাথে গঠনমূলকভাবে গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে এবং এর ওপর জোর দিতে হলে বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিকল্প নেই। এরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হবে শিক্ষা ও মনুষ্যত্বকে একত্র করে নতুন প্রজন্মকে “learning from learners” কনসেপ্ট ব্যবহার করে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সুশিক্ষা দান করা। এভাবে জাতির “মাইন্ডসেটে” পরিবর্তন আনতে হবে। তবেই সম্ভব দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। একমাত্র সুশিক্ষা ও সুস্থ্য মন-মানসিকতাই পারে নকল, দুর্নীতি, ঘুষ ও অবিচার দূর করতে। এমন প্রত্যাশা, সুদুর সুইডেন থেকে। সাথে ভালোবাসা সবার জন্য।
“- Love and honesty is the only force capable of transforming an enemy into friend.”
>> রহমান মৃধা, পরিচালক ও পরামর্শক, সুইডেন।