প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তিকে জনগণের অর্জন উল্লেখ করে এই উন্নয়ন সাফল্যকে ধরে রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই অর্জন যারা বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করেছেন তাদের সবারই এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্জন। কাজেই আমি মনে করি, বাংলাদেশের জনগণই হচ্ছে মূল শক্তি। তাদেরকে আমি অভিনন্দন জানাই। আর এই জনগণই পারে সব রকম অর্জন করতে।’ তিনি বলেন, ‘এই অগ্রযাত্রাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই জনগণের উদ্দেশেই জাতির পিতা বলে গেছেন- বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। দাবায়ে যে রাখতে পারবে না সেটাই আজকে প্রমাণ হয়েছে।’ শেখ হাসিনা আজ বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তোরণে তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা এবং এই উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
অ্যাডহক ভিত্তিতে পরিকল্পনা না নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ১০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণেই বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্রাজুয়েশন হয়েছে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সরকারের থেকে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু যারা কাজ করেছে আমার কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ থেকে শুরু করে আমাদের পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রত্যেকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁরা কাজ করেছে।
‘যারা কাজ করেন তাঁরা কিন্তু সরকারের মনভাবটা বুঝতে পারেন। আর সেটা বুঝেই তাঁরা কাজ করেন। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। কাজেই সরকার যখন আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে তখন তাঁরাও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে বলেই আজকে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৮ ভাগে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি।’
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা আর পরমুখাপেক্ষী নেই। শতকরা ৯০ ভাগ নিজেদের অর্থায়নে আমরা বাজেট করতে পারি। যে বাজেট অতীতের থেকে চারগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজনে অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সভাপতিত্ব করেন। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফজিতা ম্যানুয়েল কাতুয়া ইউতাউ কমন বক্তৃতা করেন। এউএনডিপি অ্যাডমিনিষ্ট্রেটর আসীম স্টেইনারের একটি লিখিত বার্তাও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আজম স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ থেকে উত্তোরণের সুপারিশপত্রের রেপ্লিকা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী একটি স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করেন। এ সময় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার এবং ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার মণ্ডল উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী এরপর একটি ৭০ টাকা মূল্যমানের স্মারক নোট অবমুক্ত করেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তরানা হালিম, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মালেক এবং প্রধান তথ্য কর্মকর্তা বেগম কামরুন্নাহার প্রধানমন্ত্রীর হাতে ৭০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি ফটো অ্যালবাম তুলে দেন। এরপরই শুরু হয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর পালা। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন প্রধানমন্ত্রী
রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ, জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা, ১৪ দল, সরকারি কর্মকর্তা, তিনবাহিনী প্রধান, পুলিশ বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী সমাজ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী সমাজ, সাংবাদিক সমাজ, কবি ও সাহিত্যিক, শিল্পী সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, মহিলা সংগঠন, এনজিও প্রতিনিধি দল, ক্রীড়াবিদ, শিশু প্রতিনিধি দল (স্কাউট, গালর্স গাইড, বিএনসিসি), প্রতিবন্ধী প্রতিনিধি দল, শ্রমজীবী সংগঠন এবং মেধাবী তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গ্রাজুয়েশনে পৃথক ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেজ, বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম, এডিবি প্রেসিডেন্ট তাকেহিকে নাকাও, ইউএসএআইডি অ্যাডমিনিষ্ট্রের মার্ক গ্রিন এবং জাইকার প্রেসিডেন্ট শিনিচি কিতাওকা।
এ ছাড়া দেশের খেটে খাওয়া মেহেনতি মানুষের পক্ষ থেকেও ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানো হয়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাউন্সিলের উন্নয়ন নীতিমালাবিষয়ক কমিটি (কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসি-সিডিপি) গত ১৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে তাদের ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় এবং পরের দিন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনের কাছে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি হস্তান্তর করে।
গত বছরের অক্টোবরে ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (ইউএনসিটিএডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ এরই মধ্যে তিনটি শর্ত পূর্ণ করায় চলতি মার্চ মাসে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করবে।
এই তিনটি মানদণ্ড হচ্ছে মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই), মানবসম্পদ সূচক, হিউম্যান অ্যাসেটস ইনডেস্ক (এইচএআই) এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি ইনডেস্ক (ইভিআই)।
জাতিসংঘের এই মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) হবে এক হাজার ২৩০ ডলার অথবা আরও বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬১০ ডলার। এই উত্তরণে একটি দেশের এইচএআই সূচক অবশ্যই ৬৬ অথবা বেশি এবং ইভিআই ৩২ অথবা নিচে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সূচক যথাক্রমে ৭২ দশমিক ৯ এবং ২৪ দশমিক ৮।
এই তিনটি মানদণ্ডের মধ্যে দুটি মানদণ্ড পূরণ করলেই হয়, কিন্তু বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বে প্রথম দেশ যে তিনটি মানদণ্ডই পূরণ করেছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশের চূড়ান্তভাবে উত্তরণের জন্য ২০২৪ সালে জাতিসংঘের ঘোষণা পর্যন্ত তিনটি সূচকের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।