মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। তাই এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে প্রস্তুত করতে জোরেশোরে চলছে ব্যাপক কার্যক্রম। মোংলা বন্দরের শিল্প এলাকায় অবস্থিত এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড। আর এ কর্মযজ্ঞের তৎপরতা জানান দিচ্ছে নিয়োগ ও সম্ভাবনার কথা। প্রস্তুত হওয়ার আগেই বিনিয়োগকারীদের অভাবনীয় সাড়া মেলায় এ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে উজ্জল ও অফুরন্ত সম্ভবনার আলো ছড়াচ্ছে দ্রুত গতিতে। ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ এটি বিশ্ব মানের অর্থনৈতিক অঞ্চলে রুপান্তরিত হবে এমন স্বপ্ন সবার। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে প্লট বুকিংও। প্লট নেয়ার প্রতিযোগিতায় আগ্রহী ৫টি বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।

আগামী বছরের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত এবং উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে জোরেশোরে এগুচ্ছে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল। ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য এ অর্থনৈতিক অঞ্চল আরও বেশি আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে। এতে আমদানি-রপ্তারীর প্রসারসহ কয়েক গুন গতি বাড়বে মোংলা বন্দরের। আর দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখা ছাড়াও মোংলাসহ উপকূলীয় এলাকার হতদরিদ্র মানুষের জন্য সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের।শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশ, উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে উৎসাহ দিতে, সর্বোপরি অনগ্রসর এলাকা উন্নয়নের লক্ষ্যে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজা এ উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ডেভেলপার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারী কোম্পানিটির সঙ্গে চুড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ( বেজা)। আর ২৮ ফেব্র“য়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে ভিডিও কনফারেন্সে’র মাধ্যমে মোংলা অথনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর পরই শুরু হয় প্রকল্পের কার্যক্রম। এ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পেয়েছে শিকদার গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক। ২০৫ একর ভূমিতে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে নির্মাণাধীন এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটির আগামী ৫০ বছর যাবৎ উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে পাওয়ারপ্যাক ইকনোমিক জোন লিমিটেড। প্রায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতিমধ্যে প্রশাসনিক ভবন, বাউন্ডারি ওয়াল, পানি সরবরাহ, রিজার্ভ ট্যাংক, এ্যাপ্রোচ রোড, ব্রীজ, বিদ্যুৎতের ৩৩/১১ কেভি রিসিভিং সাব ষ্টেশন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। আর নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য আনসার ক্যাম্প ও অভ্যন্তরীণ সংযোগ সড়কের কাজ করছে শিকদার গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক ইকনোমিক জোন কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিয়মিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের তৎপরতা। দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণ কাজ। ইতিমধ্যে ৯৯ ভাগই নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের জুনে। এখন চলছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য প্লট নির্মাণের কাজ। মোংলা পাওয়ারপ্যাক ইকনোমিক জোনের প্রকৌশলী (সিভিল) মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন, এ অর্থনৈতিক জোনে শিকদার গ্রুপই ৭টি উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান নির্মাণের রুপ রেখা চুড়ান্ত করেছে। এরমধ্যে রয়েছে-একটি ওয়েল টার্মিনাল, ১শ’ ও ১৬০ মেগাওয়ার্ডের দুটি পাওয়ার প্লান্ট, ৩টি স্টীল মিলর্স, কন্টেইনার লোড-আনলোডের জন্য একটি আইসিডি টার্মিনালও রয়েছে। তাদের এসব উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান নির্মাণ নিয়ে বেশ তোড়জোড় চলছে। আর প্লট বুকিংয়ের শুরুতেই এগিয়ে এসেছে একাধিক বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে রয়েছে-লাফার্জ গ্যাস, এসএমপিসি, নাগা লিমিটেড, হিন্দুস্তানী ইউনিলিভার ও বার্জার পেইন্ট লিমিটেড। প্রাথমিকভাবে এখানে ১৬টি প্লট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানায় পাওয়ারপ্যাক ইকনোমিক জোন কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টদের দাবী সরকারী ও বেসরকারী যৌথ পরিচালনায় এটি বিশ্ব মানের অর্থনৈতিক অঞ্চলে রুপান্তরিত হবে। মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী মেসার্স নুরু এন্ড সন্সের মালিক এইচ এম দুলাল বলেন, দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা বন্দর এবং ইপিজেডের পাশেই ‘মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যার পশ্চিম পাশে পশুর নদী, পূর্ব পাশে মোংলা নদী এবং উত্তর পাশে রামপাল উপজেলা অবস্থিত। মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল খুলনা বিভাগীয় শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার, রামপালের ফয়লায় নির্মাণাধীন খান জাহান আলী বিমান বন্দর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার, যশোর বিমান বন্দর থেকে প্রায় ১০৫ কিলোমিটার এবং ঢাকা শহর থেকে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। অবশ্য পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হলে ঢাকার দূরত্ব আরো অনেক কমে যাবে। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা আরো বেশি অগ্রহী হয়ে উঠবে। শিপিং ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম শুরু হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে ম্যাজিকের মতোই ঘুরবে। এতে অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারি-কর্মকর্তার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে বেজা কর্তৃপক্ষ মনে করেন।

শিকদার গ্র“পের ভাইস চেয়ারম্যান বি,এম কামাল হোসাইন বলেন, নির্মাণ কাজ শেষে পুরোপুরি চালু হলে এখানে দেশীয় বিনিয়োগকারী ছাড়াও জাপান, কোরিয়া, ভারত, পানামা, তুরস্ক, ইউক্রেন, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইতালি, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, সংযুক্ত আরব আমিরাত নতুন এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে পুঁজি বিনিয়োগ করবে। ২০১৮ সালের মধ্যে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণ কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হবে এবং আগামী বছর বিনিয়োগকারীদের প্লট বুঝিয়ে দেয়াসহ উৎপাদনে যেতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। তাই অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, ভবন ও প্লটসহ আনুসাঙ্গীক অবকাঠামো নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। পোশাক শিল্প, পাট, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, শিপ ইয়ার্ড নির্মাণ ইত্যাদি শিল্পকে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বেজার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।বেজা’র নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সালাম মন্ডল বলেন, নৌ, সড়ক ও আকাশ পথে যোগাযোগের সুবিধা বিবেচনায় রেখে মোংলা বন্দরে স্থাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব মানের অর্থনৈতিক অঞ্চল। মোংলা বন্দর জেটির নিকটবর্তী অবস্থিত হওয়ায় এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের গুরুত্ব ও বেশ সম্ভবনা রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধাকে ঘিরে এখানে আকৃষ্ট হবে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোংলা বন্দর ও সুন্দরবনের ক্ষতির সকল দিক বিবেচনায় রেখে অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানা নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সকল প্রস্তুতি রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর একেএম ফারুক হাসান বলেন, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু, রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, খান জাহান আলী বিমান বন্দর, মোংলা-খুলনা রেল লাইন ও মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ এ এলাকায় চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন বাস্তবায়িত হলে মোংলা বন্দরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। এবং এ বন্দরের উপর ব্যাপক চাপ পড়বে। সেই চাপ মোকাবেলায় এখন থেকেই বন্দরকে আরো বেশি আধুনিকায়নসহ প্রয়োজনী প্রস্তুতি সম্পন্নের কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শতভাগ সেবা নিশ্চিত ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বন্দর কর্তৃপক্ষ উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মংলা-রামপালের (বাগেরহাট-০৩) স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ, আর উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে সম্ভবনাময় মোংলা বন্দর ও বন্দর এলাকায় গড়ে উঠা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল মোংলা বন্দরের ভবিষ্যৎ আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্যে ব্যাপক সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। এতে মোংলা ও রামপালসহ আশপাশের বেকার জনগোষ্টীর সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের।