পবিত্র হজে¦র পর বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত এবারের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব আজ (শুক্রবার) বাদ ফজর থেকে আম বয়ানের মাধ্যমে টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদীর তীরে শুরু হচ্ছে। দ্বিতীয় দফায়ও বহাল রয়েছে আগের দফার সকল প্রস্তুতি। প্রথম পর্বের পর চার দিন বিরতি দিয়ে শুরু হচ্ছে এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। তবে বৃহস্পতিবার মাগরিব নামাজে পর ময়দানের ছামিয়ানার নিচে জমায়েত হওয়া মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে অনানুষ্ঠানিক বয়ান শুরু হয়েছে। আগামী রবিবার জোহরের নামাজের আগে (পূর্বাহ্নে) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবছরের এজতেমা শেষ হবে। দ্বিতীয় পর্বের এজতেমায় যোগ দিতে ঢাকা জেলার একাংশ এবং ১২টি জেলার মুসল্লিদের এজতেমা স্থলে আসা অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে এজতেমা মুখি মানুষের ঢল নামে টঙ্গীর দিকে। বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে মুসল্লিরা যোগ দিচ্ছেন এজতেমায়।
বিশ্ব এজতেমার মুরুব্বী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, বিশ্ব এজতেমার এ পর্বে ঢাকাসহ ১৩জেলার মুসুল্লিরা অংশ নেবেন। এজন্য এজতেমা ময়দানকে ২৮টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ব এজতেমার এ পর্বেও বিদেশি মুসুল্লিরা অংশ নেবেন। আগামি ২১ জানুয়ারি (রবিবার) দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে ৫৩তম বিশ্ব এজতেমা। আজ (শুক্রবার) হওয়ায় দেশের সর্ব বৃহৎ জু’মার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে এজতেমা ময়দানে। গাজীপুর, ঢাকার উত্তরা ও আশপাশের এলাকা থেকে লাখ লাখ মুসল্লি যোগ দেবেন এই জু’মার নামাজে।
এজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, দ্বিতীয় পর্বের এজতেমায় যোগ দিতে ইতোমধ্যে কয়েক লাখ মুসল্লী এজতেমা মাঠে সমবেত হয়েছেন। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসুল্লীদের এ আগমন অব্যাহত থাকবে। তারা নিজ নিজ জেলার খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন। প্রথম পর্বে অংশ নেয়া বেশ কিছু বিদেশী মুসল্লি দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেয়ার জন্য ময়দানের বিদেশী নিবাসে রয়ে গেছেন।
এজতেমা আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য প্রকৌশলী মোঃ গিয়াস উদ্দিন জানান, এবারের বিশ্বএজতেমার প্রথম দফার সকল প্রস্তুতি দ্বিতীয় দফাও বহাল রয়েছে। ইতোমধ্যে মুসুল্লীরা এজতেমাস্থলে আসতে শুরু করেছেন। গত ১৪ জানুয়ারি (রবিবার) প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতের পর দ্বিতীয় পর্বের এজতেমার ময়দান প্রস্তুতের জন্য এজতেমায় আগত তাবলিগ জামাতের কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন। তারা এজতেমার প্রথম পর্বে মুসল্লিদের ফেলে রাখা ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে পুরো ময়দানকে উপযোগী করে তুলেছেন। এ জন্য ময়দানে তাবলিগের কর্মীরা বেশ কয়েকটি দলে বিভিক্ত হয়ে এ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালায়। এছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও ময়দান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজে অংশ নেয়। আগামী রবিবার (২১জানুয়ারি) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব এজতেমা।
এবারও বিশ্ব এজতেমা ময়দানের পশ্চিম-উত্তর দিকে বিদেশী মুসুল্লীদের অবস্থানের জন্য বিশেষ আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বিদেশী নিবাসে রন্ধনশালায় সার্বক্ষণিক গ্যাস ও বিশুদ্ধপানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সেখানে অ্যাম্বুলেন্স ও টেলিফোনসহ প্রয়োজনীয় আধুনিক সুবিধাদি রয়েছে। এ ছাড়াও বিদেশি নিবাসে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এবার ক্রমবর্মান বিদেশী মুসুল্লীদের জন্য ২০শতাংশ আবাসনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে।
দ্বিতীয়পর্বে ১৩ টি জেলার মুসুল্লিগন অংশ নেবেন ॥ দ্বিতীয় পর্বের এজতেমায় মুসুল্লিদের অংশ নেয়ার জন্য জেলাওয়ারি পুরো প্যান্ডেলকে ২৮টি খিত্তায় (ভাগে) ভাগ করা হয়েছে। এতে ঢাকার একাংশসহ ১৩টি জেলার মুসুল্লিগন অংশ নেবেন। দ্বিতীয় পর্বে দেশের বিভিন্ন জেলার মুসল্লীরা খিত্তাওয়ারী যেভাবে অবস্থান নেবেন তা হলো- তা হলো-১ নং থেকে ১০নং, ১৮ নং ও ১৯ নং খিত্তায় ঢাকা জেলা, ১১ নং ও ১২ খিত্তায় জামালপুর, ১৩ খিত্তায় ফরিদপুর, ১৪ নং খিত্তায় কুড়িগ্রাম, ১৫ নং খিত্তায় ঝিনাইদহ, ১৬ নং খিত্তায় ফেনী, ১৭ নং খিত্তায় সুনামগঞ্জ, ২০ নং খিত্তায় চুয়াডাঙ্গা, ২১ ও ২২ নং খিত্তায় কুমিল্লা, ২৩ ও ২৪ নং খিত্তায় রাজশাহী, ২৫ ও ২৭ নং খিত্তায় খুলনা, ২৬ নং খিত্তায় ঠাকুরগাও এবং ২৮ নং খিত্তায় পিরোজপুর জেলা।
গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, বর্তমান সরকারের নির্দেশে প্রতিবারের ন্যায় এজতেমা ময়দানের এজতেমায় আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে এবছরও গোসলখানা, ওযুখানাসহ উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রথম দফার এজতেমার মত দ্বিতীয় দফাও এজতেমা ময়দান ও আগত মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখব ইনশাল্লাহ্।
গাজীপুরে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, দ্বিতীয় দফার জন্যও আমাদের আগের দফার মত ব্যাপক ও সর্বাঙ্গীন প্রস্তুতি রয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মুসুল্লীরা ভালমত এজতেমা সেরে ফিরে যেতে পারে তার জন্য সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় গাজীপুর পুলিশ সুপার মো. হারুন-অর-রশীদ জানান, বিশ্ব এজতেমায় দায়িত্ব পালনের জন্য ৭হাজার পুলিশ সদস্য প্রস্তুত রয়েছে, নেয়া হয়েছে ৭স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাবলীগ জামাতের দ্বন্দের কোন প্রভাব এজতেমায় পড়বে না জানিয়ে তিনি বলেন, অর্ধশতাধিক অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা এবং ওয়াচ টওয়ার থেকে বাইনোকুলারের মাধ্যমে এজতেমা ময়দান ও এর আশপাশের এলাকা মনিটরিং করা হচ্ছে। এজতেমা ময়দানে যাতে মুসল্লিরা নির্বিঘেœ আসতে পারেন সেজন্য যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছে। এর পাশাপাশি তুরাগ নদীতে নৌ পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। এজতেমা ময়দানের প্রতিটি খিত্তা ও ময়দানের আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছে। ময়দানের আশপাশের এলাকা হকার ও ভিক্ষুকমুক্ত করা হয়েছে। এজতেমায় আগত বিদেশী মেহমানদের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। ৭ স্তরের এ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে এজতেমা ময়দান এলাকা ঢেকে রাখা হবে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যেন ঘটতে না পারে সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে।
চিকিৎসা সেবা ॥ গাজীপুরের সিভিল সার্জন জানান, প্রথম ধাপের ন্যায় দ্বিতীয় ধাপেও এজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে তাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিক্যাল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। মুসল্লী¬দের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মন্নু গেট, এটলাস গেট, বাটা কারাখানার গেট অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ জেনারেল হাসপাতালে হৃদরোগ, অ্যাজমা, ট্রমা, বার্ন, চক্ষু এবং ওআরটি কর্নারসহ বিভিন্ন ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেবেন। এ ছাড়াও বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ঔষধ কারখানা প্রতি বছরের ন্যায় এপর্বেও এজতেমা ময়দানে মুসল্লি¬দের ফ্রি চিকিৎসা ও ঔষধপত্র বিতরণ শুরু করেছে। হার্মদদ (ওয়াকফ) লিঃ, ইবনে সিনা, র্যাব, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যান সমিতি, আয়ুর্বেদীয় মেডিকেল, জনকল্যান মেডিকেল অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র এজতেমা ময়দানের উত্তর পার্শ্বে নিউ মন্নু কটন মিলের অভ্যন্তরে চালু করেছে।
ভ্রাম্যমান আদালত ॥ গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে এজতেমা মাঠ ও এর আশপাশ এলাকাকে ২০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন ২টি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। বুধবার বিকেল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের কার্যক্রম শুরু করেছেন।
গাড়ি পার্কিং ॥ প্রথম পর্বের ন্যায় দ্বিতীয় পর্বেও বিশ্ব এজতেমায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মুসল্ল¬ীদের সুবিধার্থে টঙ্গী পাইলট স্কুল এন্ড কলেজ মাঠ, টঙ্গী সফিউদ্দিন সরকার একাডেমী এন্ড কলেজ মাঠ, উত্তরার আজমপুর স্কুল মাঠ, কামারপাড়ায় রানাভোলা মাঠে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশ^ এজতেমার মুরুব্বী গিয়াস উদ্দিন আরো বলেন, বিশ্বএজতেমায় অংশ নেওয়া মুসল্লীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০১১সাল থেকে দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লীদের জন্য দুই দফায় বিশ্ব এজতেমা শুরু হয়। ইতোপূর্বে ৬৪ জেলার মুসুল্লীদের জন্য তিনদিনের এক দফায় বিশ্ব এজতেমা অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু টঙ্গীর এজতেমা ময়দানে ক্রমবর্ধমান মুসুল্লীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৫সাল থেকে দেশের ৩২টি জেলার মুসল্লীদের জন্য দুই দফায় বিশ্ব এজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতে এক বছর পর পর ৩২ জেলার মুসল্লীরা এজতেমায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। অর্থাৎ এক বছর যে সকল জেলার মুসল্লীরা দুই পর্বের বিশ্ব এজতেমায় অংশ নিয়েছেন, ওই সকল জেলার মুসল্লীরা পরবর্তী বছর এজতেমায় অংশ নিতে পারবেন না। তারা যার যার জেলায় আঞ্চলিক এজতেমায় অংশ নেবেন। ২০১৫ সাল থেকে এ আঞ্চলিক এজতেমা শুরু হয়েছে। তবে ঢাকা জেলায় মুসল্লী বেশি হওয়ায় ঢাকাকে চার অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। চার অঞ্চলের এসব মুসল্লীদের বিশ্ব এজতেমায় অংশগ্রহণের সুব্যবস্থা করতে প্রতি দুই বছর প্রত্যেক দফায় এজতেমা ময়দানে তাদের (খিত্তা) অবস্থান রাখতে হচ্ছে। যার কারণে প্রথম দফায়ও ঢাকা জেলার একাংশের মুসুল্লীরা অংশ নিয়েছেন।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে