হিন্দুবিবাহের অন্যতম উপকরণ মুকুট, ঘরের দরজায় লাগানো কদম ফুল, মন্দিরের সামনে লাগানো বের কপালী, মনসা পূজার উপকরণ এ সকল উপকরন সনাতন ধর্মালম্বিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য থাকলেও সৌন্দর্য বর্ধনে ও দেখার শোভায় এগুলো অনন্য দৃষ্টি নন্দন বিষয়াবলী। কালের বিবর্তনে আধুনিকায়নের ছোয়ায় এসকল উপকরন তৈরির কারিগরদের জীবিকার তাগিদে বর্তমানে তাদের ভবিষ্যত শঙ্কা হিসেবেই দেখা দিয়েছে। পাবনার চাটমোহর উপজেলার পৌর সদরের বালুচর মহল্লার ফুল সোলার কারিগর ননী গোপাল মালাকারকে দেখে বুঝবার উপায় নেই বয়সে প্রায় নব্বইয়ের কোঠা পৌছে গেছেন তিনি। সাবলীল ভাবে নিজের কথা, পরিবারের অবস্থা, অতীত বর্তমান, পেশার ভবিষ্যতের শঙ্কার কথা অকপটে বলছিলেন তিনি।
ননী গোপাল মালাকার জানান, ফুল সোলার স্থানীয় নাম ভ্যাতা সোলা। এই ফুল শোলা থেকে তিনি এবং তার স্ত্রী গৌড়ি মালাকার হিন্দুবিবাহের অন্যতম উপকরণ মুকুট, ঘরের দরজায় লাগানো কদম ফুল, মন্দিরের সামনে লাগানো বের কপালী, মনসা পূজার উপকরণ বের তৈরী ও বিক্রি করেন। আগেকার দিনে এ এলাকার বিলে; বিশেষত ধান ক্ষেতে এ সোলা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যায় না। রংপুর দিনাজপুর রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখন আমাদের এ সোলা সংগ্রহ করতে হয়। প্রতি বোঝা সোলার দাম পরে প্রায় তিন চার হাজার টাকা। ঠিক মতো সোলা পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও দাম খুব বেশি পরছে এবং পরিবহন করে আনতে কষ্ট হচ্ছে। সোলা দুষ্প্রাপ্য হলেও বিভিন্ন যায়গায় খোঁজ খবর করে বছরে দুইবার কিনে এনে কাজ করছেন তিনি।
তিনি আরো জানান, প্রতিটি বিয়ের মুকুট বর্তমানে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকায়, অন্ন প্রাশনের ছোট মুকুট ৩শ থেকে ৪শ টাকা, পৌষ সংক্রান্তিতে ঘরের দড়জায় বাধা কদম ফুল আকার আকৃতি অনুযায়ী ১৫ থেকে ৪০ টাকা জোড়া, বের কপালী ১শ থেকে ১শ ৫০ টাকায় এবং মনসা পূজার মের ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। ফুল শোলার উপকরণ তৈরী করে প্রতিদিন কেমন টাকা আয় করেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আসলে এ কাজ করে প্রতিদিনের আয় কত এটা বলা মুশকিল। ৪০ বছর ধরে কাজটি করে আসছি। দিনে দিনে তৈরী ও বিক্রি করি। যাদের প্রয়োজন তারা অর্ডার দিয়ে যান। আবার অনেক সময় রেডিমেড ও বানিয়ে রাখি। যার যেটা পছন্দ ও যেটা মাপ মতো হয় তিনি সেটা দাম দর করে কিনে নিয়ে যান। এগারো শতক বসত বাড়ি ব্যতীত অন্য কোন জমা জমি নেই। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে এ কাজ করি। যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে কোন মতে দিনাতিপাত করছি।
কোন পেশাই যে ছোট নয় একথা মানতে নারাজ ননী গোপাল মালাকারের স্ত্রী গৌড়ি মালাকার। ৫০ ছুই ছুই করছে তার বয়স। স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে ফুল শোলার সামগ্রী তৈরী ও বিক্রি করে কোনমতে দিনাতিপাত করছেন বলে জানান। তিনি আরো জানান, দীর্ঘকাল যাবত এ কাজ করে আসছেন তারা। অপর কারিগর সুভাষ মালাকারের বয়স ৭০ বছর। পূর্বে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বসবাস করতেন। বৈবাহিক সূত্রে বসতি গড়েছেন চাটমোহরের বালুচর মহল্লায়। তিনি জানান, উল্লাপাড়া ও চাটমোহরের হোটেল রেষ্টুরেন্টে প্রায় ৫০ বছর মিষ্টি বানানোর কাজ করেছেন তিনি। তখন অবসর সময়ে ফুল সোলার কাজ করতেন। এখন হোটেলের কাজ বাদ দিয়ে বাড়িতে ফুল সোলার কাজ করেন। চার ছেলে এক মেয়ে তার। বড় ছেলে প্রভাত মালাকারের পৃথক সংসার। স্ত্রী ও অন্য ছেলেদের নিয়ে এক অন্নে বসবাস করছেন। বসত বাড়িটিও নিজের পৈত্রিক বা কেনা নয় তার। শ^শুরের জায়গায় বসবাস করছেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন বেশ আগেই। ফুল শোলার সংকটে অনেক সময় কাজ বন্ধ রাখতে হয়। সব মিলিয়ে কোন মতে এ পেশায় টিকে আছেন এবং সংসার পরিচালনা করছেন বলে জানান তিনি। মনোতোষ মালাকার একজন মুদী দোকানী। বালুচর মহল্লায় নিজ বাড়ির সামনে দোকান করেছেন। দোকানে বেঁচা কেনার ফাঁকে ফাঁকে ফুল সোলার কাজ করেন। তিনি জানান, সময় পেলে করি না পেলে করি না। অবসর সময় টুকু কাজে লাগিয়ে যেহেতু বাড়তি কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যায় তাই কিছুটা ঝামেলা হলেও কাজটি করে আসছি বলে জানান তিনি। কেবল ননী গোপাল, গৌড়ি, সুভাষ, পরিতোষ, মনোতোষ মালাকারই নয় এমন আরো অনেকে ফুল সোলার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার কেবল মালাকাররাই নয় চাটমোহরে অন্য সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ও বর্তমানে এ কাজের সাথে জড়িত। তবে উপকরণ সংকটের কারণে এ পেশার সকলেই নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
এস এম মাসুদ রানা চাটমোহর (পাবনা)