রবিবার সকাল থেকে নওগাঁর আত্রাইয়ে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সীতারাণীর স্মৃতি বিজড়িত সীতাতলার মেলা। নওগাঁ জেলার সর্ববৃহৎ এ মেলাকে ঘিরে এখন এলাকায় চলছে উৎসবের আমেজ। আত্রাই উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে নিভৃত পল্লী জামগ্রাম। বর্ষাকালে নৌকার বিকল্প কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। শুস্ক মৌসুমে পায়ে হাটারও কোন বিকল্প নেই। তবে ভোঁপাড়া তিলাবদুরী হয়ে মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ও ভ্যানের যোগাযোগ কিছুটা হলেও বৃষ্টি এলে এ দুঃখের শেষ নেই। এই জামগ্রামেই সেই যুগ যুগ থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মেলা।

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আজ রবিবার থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী সীতাতলার মেলা। কথিত আছে, শত শত বছর পূর্বে রামচন্দ্র তার স্ত্রী সীতা রাণীকে এই আত্রাই উপজেলার গহীন বন জামগ্রামে বনবাস দিয়েছিলেন। আর সীতা বনবাসের এক পর্যায় জামগ্রামের এ বনে একটি প্রকান্ড বটগাছের নিচে আশ্রয় নেন এবং জীবনের বাঁকি সময় এ বট গাছটির নিচেই তিনি কাটিয়ে দেন। গাছটির পার্শে রয়েছে এক বিরাট ইন্দারা। সীতা এই ইন্দারার পানিতেই স্নান করতেন। বিশ্বকর্মা এক রাতেই নাকি নির্মাণ করেছিলেন এই ইন্দারা। সেই রেশ ধরেই সীতার নামেই মেলার নামকরন করা হয়েছে ‘সীতাতলার মেলা’। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী সীতাতলার মেলা জমজমাট ভাবে প্রতি বছর হয়ে আসছে। শুরুর দিকে এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের মেলা থাকলেও বর্তমানে আর তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এ মেলা হিন্দু, মুসলিম সকলের এক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। মেলাকে ঘিরে নওগাঁসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার লোক সমাগম হয় এই মেলায়। মূল মেলা তিনদিন হলেও মেলার আগেও পরে কয়েকদিন ব্যাপী চলে মেলার বেচা-কেনা। মেলাকে ঘিরে উপজেলার জামগ্রামসহ পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে এখন সাজসাজ রব পড়ে গেছে। মেলা উপলক্ষে যেন আশপাশের গ্রামগুলোতে উৎসবের ধুম পড়েছে। দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনে ভওে গেছে প্রায় প্রতিটি বাড়ি। প্রতি বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের মিঠাই মিষ্টান্ন পিঠা ও ভালো খাবারের ব্যাবস্থাও করা হয়েছে। মেলাকে ঘিরে আশপাশের গ্রামে জামাই আদর রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ঘরে ঘরে শীতের রস-পাটালির নানান পিঠা- পায়েস তৈরির ধুম। ঈদে না হলেও অন্তত মেলা উপলক্ষে জামাই-মেয়েকে দাওয়াত দেওয়া এ এলাকার রেওয়াজ। জামাই মেলা থেকে বড় মাছ-মিষ্টি নিয়ে শশুরালয়ে যান। আর শশুর জামাইকেও উপহার দিয়ে থাকেন। তাই জামগ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে এখন জামাই, মেয়ে বিয়াই, বিয়ানসহ আতœীয় স্বজনের পদচারণায় মুখরিত।

ঐতিহাসিক এ মেলাকে কেন্দ্র করে জেলা সদরসহ পার্শ্ববর্তী বগুড়া, সান্তাহার, নাটোর, জয়পুরহাট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর লোকজন এই মেলাই বেড়াতে এসে ব্যাপক কেনা-কাটাও করে। এ মেলাকে নিয়ে জামগ্রামের গৃহবধূ নিশাত আনজুমান বলেন, মেলা উপলক্ষে আমার পিত্রালয় সিরাজগঞ্জ থেকেও আতœীয় স্বজন এসেছে তারা আনন্দো করবে বলে। আশা করছি মেলাতে আনন্দও হবে গত বছরের চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি। ওই গ্রামের ব্যবসায়ী মো: জনি সোনার বলেন, ঈদ উৎসবে জামাই মেয়ে না এলেও এ মেলার সময় তাদেও নিয়ে আসতেই হয়। এদিকে মূল মেলা তিন দিন হলেও আয়োজন চলছে বেশ কয়েকদিন থেকে এবং শেষ হবারপর অঘোষিতভাবে তা চলে আরও কয়েকদিন। মেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি মো: মোসলেম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, রবিবার, সোমবার ও মঙ্গলবার এই তিনদিন সকাল-সন্ধ্যা একটানা মেলা চলবে, ঐতিহাসিক সীতাতলার এই মেলাটির ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আমরা প্রতি বছর এই মেলার আয়োজন করি।
আত্রাইয়ের ঐতিহ্যবাহী মেলাকে ঘিরে আইন শৃংঙ্খলার কথা জানালেন আত্রাই থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: মোবারক হোসেন, তিনি বলেন সীতাতলার মেলাকে ঘিরে নিরাপত্তার জোরদার করা হয়েছে। আনন্দঘন পরিবেশে মেলাই আসা লোকজনের নিরাপত্তার জন্য সেচ্ছাসেবক, গ্রাম পুলিশ ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আশাকরছি প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মেলাতে কোন অপৃতিকর ঘটনা ঘটবে না।