এবারের বিশ্ব এজতেমার আখেরি মোনাজাত ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে ছাড়াই রবিবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাকে নিয়ে বিতর্ক উঠার পর মাওলানা সাদ বাংলাদেশে এলেও টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমায় অংশ না নিয়েই শনিবার ফিরে গেছেন। মাওলানা সা’দ গত কয়েক বছর ধরে এজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করলেও এবার তার এর পরিবর্তে বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের ইমাম হযরত মাওলানা যোবায়ের হাসান বাংলা ভাষায় আজ (রবিবার) আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে এজতেমা সূত্রে জানা গেছে। বেলা ১১টার দিকে আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন এজতেমা শীর্ষ স্থানীয় মুরুব্বিরা। এদিকে নানা বিতর্কের অবসান ঘটাতে মাওলানা সা’দ এবারের বিশ্ব এজতেমায় অংশ না নিয়ে ফিরে যাওয়ায় তার অনুপস্থিতি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না তার অনুসারীরা। তাই অর্ধশতাধিক বিদেশী মুসল্লী এজতেমার প্রথম পর্ব সম্পন্ন হওয়ার আগেই ময়দান থেকে চলে গেছেন। আগামী বছর বিশ্ব এজতেমা অনুষ্ঠিত হবে ১১ জানুয়ারি হতে।
এদিকে দেশ- বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের পদচারণায় কহর দরিয়াখ্যাত টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের বিশ^ এজতেমাস্থল এখন মুখরিত। শিল্প নগরী টঙ্গী এখন যেন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। এবারের এজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবার আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান ও রাসুল (সঃ) প্রদর্শিত তরিকা অনুযায়ী জীবন গড়ার আহ্বান জানিয়ে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি জিকির আসকার, ইবাদত বন্দেগী আর ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পবিত্র কোরআনের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছে। আজ (রবিবার) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিমবিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত এবারের ৫৩তম বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব। সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বি বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের ইমাম হযরত মাওলানা যোবায়ের হাসান আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে জানিয়েছে আয়োজক কমিটি। এজতেমা ময়দানে বিদেশী নিবাসের পূর্বপার্শ্বে বিশেষভাবে স্থাপিত মঞ্চ থেকে এ মোনাজাত পরিচালনা করা হবে। এরআগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়তি বয়ান। রবিবার হেদায়তি বয়ান ও আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে এবারের বিশ্ব এজতেমার তিন দিনের প্রথম পর্ব। এরপর চারদিন বিরতি দিয়ে আগামি শুক্রবার শুরু হবে তিন দিনের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। আখেরি মোনাজাতে মুসল্লীদের আসা ও যাওয়া নিরাপদ করতে শনিবার দিবাগত মধ্য রাত থেকে মোনাজাত অনুষ্ঠাণ পর্যন্ত এজতেমা ময়দানগামী সড়কে যানবাহ চলাচলে বিধি নিষেধ আরোপ করেছে পুলিশ। এদিকে এবারও বিশ্ব এজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুক বিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি।
মহান আল্লাহতাআলার নৈকট্য লাভের ব্যাকুলতায় দ্বীনের দাওয়াতে মেহনত করার জন্য ইসলামের মর্মবাণী সর্বত্র পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা দলে দলে ছুটে আসছেন টঙ্গীর তুরাগ তীর এজতেমা ময়দানে। শনিবারও টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। রবিবার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে এজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে অনেক মুসুল্লী নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে পলিথিন সিট ও কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে তাতেই অবস্থান নিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার বন্দনা, আরজ-গুজার, শোকরানা আর ইবাদত বন্দিগীতে মশগুল মানুষের কলরব। সৃষ্টিকর্তার দিদার লাভের জন্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পায়ে হেঁটে, র্যাব ও পুলিশ পাহারায় বাস ও ট্রেনে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব এজতেমা ময়দানে সমবেত হয়েছেন। এদিকে ২০১৫ সাল হতে দেশের মোট ৬৪টি জেলাকে দু’বছরে চার পর্বে বিভক্ত করে এজতেমার আয়োজন করায় এবারের প্রথম পর্বের এজতেমায় আগত মুসল্লীরা স্বস্তিতে ও নির্বিঘেœ সময় কাটিয়েছেন। এলাকাবাসিও নানা ভোগান্তি থেকে অনেকটা মুক্ত ছিল।
এদিকে এবারও তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বীরা রেডিও-টিভিতে আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারে অনুমতি দেননি। ক্যামেরাও মুরুব্বীদের ছবি তোলাও বারণ করে দিয়েছে এজতেমা কর্তৃপক্ষ। তারপরও কিছু কিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইজতেমা কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
এবার আখেরি মোনাজাত করবেন বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়ের ॥ এবারে টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমায় ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভি অংশ নিচ্ছেন না। ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভি গত বুধবার বাংলাদেশে এলেও তাকে নিয়ে বিতর্ক উঠায় টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমায় অংশ না নিয়েই শনিবার দুপুরে জেড এয়ারওয়েজের একটি বিমানে বাংলাদেশ থেকে ফিরে গেছেন। ভারতের মাওলানা জোবায়রুল হাসান মারা যাওয়ার পর তিনিই (মাওলানা সাদ) বিশ্ব এজতেমায় তার হাল ধরেছিলেন। বিশ্ব এজতেমায় উর্দূতে বয়ান করা ছাড়াও তিনি একই ভাষায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতেন। কিন্তু এবার আখেরি মোনাজাত ও হেদায়তি বয়ান দুই-ই হবে বাংলায়। শুক্রবার রাতে কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ মুরুব্বিদের এক পরামর্শ সভায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনাকারীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জানা গেছে, প্রায় ১০০বছর আগে ইসলামের দাওয়াতি কাজকে ত্বরান্বিত করতে মাওলানা ইলিয়াছ শাহ (রহ.) দিল্লীর নিজামুদ্দিন মসজিদ থেকে তাবলিগের কাজ শুরু করেন। মাওলানা ইলিয়াছের (রহ.) ছেলে মাওলানা হারুন (রহ.)। তারই ছেলে হলে মাওলানা সাদ কান্ধলভী। ২০১৫সাল থেকে মাওলানা সাদ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করে আসছেন। এরআগে তিনি টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমা ময়দানে শুধু তাবলীগের বয়ান দিতেন।
বিশ্ব এজতেমা আগামী বছর শুরু হবে ১১ জানুয়ারি ॥ আগামী বছর বিশ্ব এজতেমা ১১ জানুয়ারি হতে অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার রাতে কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ মুরুব্বিদের এক পরামর্শ সভায় ওই তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
বিশ্ব এজতেমার মুরুব্বি মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব ১১, ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এবং চারদিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্ব ১৮, ১৯ ও ২০জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।
বিদেশী অর্ধশতাধিক মুসল্লি ফিরে গেছেন ॥ নানা বিতর্কের অবসান ঘটাতে মাওলানা সা’দ এবারের বিশ্ব এজতেমায় অংশ না নিয়ে ফিরে যাওয়ায় তার অনুপস্থিতি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না তার অনুসারীরা। তাই এবারের বিশ্ব এজতেমায় যোগ দিতে আসা ৫৮জন বিদেশী মুসল্লী এজতেমার প্রথম পর্ব সম্পন্ন হওয়ার আগেই ময়দান থেকে চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক মুসল্লি।
গাজীপুর পুলিশের জেলা বিশেষ শাখার ইন্সপেক্টর মোমিনুল ইসলাম জানান, শনিবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৯টি দেশের ৪হাজার ৫৩১ জন বিদেশী নাগরিক টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমা ময়দানে এসে যোগ দেন। এদের মধ্যে শুক্রবার আমেরিকার ১১জন, মালেয়েশিয়ার ১৫জন ও ইন্দোনেশিয়ার ১২জন মুসল্লী এবং শনিবার ইন্দোনেশিয়ার আরো ২০জন মুসল্লী টঙ্গীর এজতেমা ময়দান থেকে ফিরে গেছেন। তবে তারা কেন চলে গেছেন তা জানা যায় নি।
দ্বিতীয় দিন (শনিবার) যারা বয়ান করলেন ॥ নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ি বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবার মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে বাদ ফজর বয়ান করেন কুয়েতের মুরুব্বি ইব্রাহিম রেফা। তার বয়ান বাংলায় তর্জমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। এরপর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে যোহরের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের কাকরাইলের মাওলানা হাফেজ জোবায়ের। এছাড়াও বাদ যোহর সুদানের মাওলানা ড. জাহাদ, বাদ আসর বাংলাদেশের নূরুর রহমান ও বাদ মাগরিব মাওলানা ফারুক হোসেন বয়ান করেন। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি এজতেমা ময়দানে অবস্থান করে ফজিলতপূর্ন এ বয়ান শুনেন।
যা বয়ান করলেন ॥ তাবলিগ জামাতের মুরুব্বীগণ এজতেমার সুবিশাল ময়দানে সমবেত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশ্যে তাবলিগের ছয় উসুল যথা কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিয়ে নিয়ত এবং তাবলিগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। বয়ানে তাবলীগ মুরব্বীরা বলেন, যতদিন দ্বীন থাকবে, তত দিন দুনিয়া থাকবে। আর দ্বীন টিকে থাকবে দাওয়াতের মাধ্যমে। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করে গেছেন। ফেরাউনের কাছেও দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে আল্লাহ্ হযরত মুসা (আ:) কে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ যাল্লে জালালুহু নবী-রাসুলদেরকে তাদের নিজের পরিবার ও বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা:) কে সারা দুনিয়ায় দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আজ তিনি নেই। এ কাজের জিম্মাদারী এখন তার উম্মতের ওপর।
বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ ॥ বিশ্ব এজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের ১৫-২০জন শুরা সদস্য ও বুজর্গ বয়ান পেশ করেন। মূল বয়ান উর্দূতে হলেও বাংলা, ইংরেজী, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ হচ্ছে। বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরুব্বী মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান। মূল বক্তা বয়ানের একটি নির্দিষ্ট অংশ শেষ করার পর অনুবাদের জন্য বিরতি দেন। অনুবাদ শেষ হলে তিনি আবার বয়ান শুরু করে। এভাবেই এজতেমা ময়দানে তাবলীগ জামাতের মুরব্বীদের বয়ান চলে।
তাশকিলের কামরায় চিল্লাভুক্ত মুসুল্লী ॥ এজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহনেচ্ছু মুসুল্লীদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইলের মসজিদের তাবলিগি মুরুব্বীদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ি এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলিগি কাজে পাঠনো হবে।
আখেরী মোনাজাতের প্রস্তুতি ॥ আজ (রবিবার) এজতেমার মূল আকর্ষণ আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এজতেমা মাঠের বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকে রবিবার সকাল ১০ টা থেকে ১১টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বিশ^ এজতেমার মুরুব্বী মাওলানা গিয়াস উদ্দীন। এর আগে হবে হেদায়তি বয়ান। রবিবার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসল্লীদের ঢল অব্যাহত থাকবে। এজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে বিপুল সংখ্যক মহিলা টঙ্গীর আশপাশে এসে অবস্থান নিয়েছেন। অনেকে তাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে উঠেছেন। রবিবার হেদায়তি বয়ান ও আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব এজতেমার তিন দিনের প্রথম দফা। আগামি শুক্রবার শুরু হবে তিন দিনের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় দফা।
বিদেশীসহ আরো দুই মুসল্লির মৃত্যু ॥ বিশ^ এজতেমা ময়দানে শুক্রবার রাতে এক বিদেশীসহ আরো দুই মুসল্লি মারা গেছেন। শুক্রবার রাতে বিদেশী কামরায় মালেশিয়ার নাগরিক নূরহান বিন আব্দুর রহমান (৫৪) ওজু করতে গিয়ে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। তাকে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়াও রাত সাড়ে ১১টার দিকে লক্ষীপুর জেলা সদরের রূহিতা গ্রামের শামসুল হকের ছেলে রফিকুল ইসলাম (৫৪) নিজ খিত্তায় অসুস্থ্য হয়ে মারা যান। এ নিয়ে গত দুই দিনে ইজতেমা ময়দানে এ পর্যন্ত তিনজন মুসল্লি মারা গেছেন।
এবারও যৌতুকবিহীন বিয়ে হয়নি ॥ বিশ^ এজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ আছর এজতেমা ময়দানে কণের অনুপস্থিতিতে যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করা হতো। গত বছরের মতো এবছরও ওই বিয়ের আয়োজন থাকছেনা বলে জানিয়েছেন বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন।
তিনি জানান, বিগত বছরগুলোতে বিশ্ব এজতেমা ময়দানে কণের অনুপস্থিতিতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হতো। গত বছর তা হয়নি। এবছরও ওই বিয়ের আয়োজন থাকছেনা। এজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে তা কেবল এই ময়দানে আসা তাবলিগি সদস্যরা ও মুসুল্লীরা জানতে পারেন। এলাকার লোকজন এমনকি অনেক স্বজনরাও তা জানতে পারেন না। ফলে ওই বিয়ের আকর্ষণ কমে যায়। এজন্য গত বছর থেকে এজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ের জন্য তালিকা ভুক্ত হলেও তাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ওই বিয়ের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। তাই গত বছরের মতো মাঠে ওই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নেই।
তিনি আরো জানান, বিশ্ব এজতেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল যৌতুক বিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ শরীয়ত মেনে তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ি এজতেমার দ্বিতীয় দিন (শনিবার) বাদ আছর এজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর বসতো। কনের সম্মতিতে ও তার অনুপস্থিতিতে বর এবং কণে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হত ওই বিয়ে। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হতো ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানার পরিমান ধরা হয় দেড়শ’ তোলা রুপা বা উহার সমমূল্য অর্থ।
এবার প্রায় ৬ হাজার জামাত তাবলিগের দাওয়াত নিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে ॥ তাবলিগ জামাতের অন্যতম মুরব্বি বলেন, তাবলিগের একমাত্র কাজই আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা। রাসূল (সাঃ)-এর বিদায় হজের ভাষণের মূল বাণী হিসেবে আমরা আল্লাহর পথে ডেকে থাকি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর একমাত্র লক্ষ্য। একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের একক আনুকূল্যে এই এজতেমা হয়ে থাকে। টঙ্গীর এই এজতেমা থেকেই বিশ্বের অন্ততঃ ১৫০টি দেশে দাওয়াতের এই কাজ করা হয়। প্রতি বছর টঙ্গী এজতেমা থেকেই পাঁচ থেকে ছয় হাজার জামাত বিশ্বব্যাপী পাঠানো হয়। আগত বছরের বিশাল কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনা টঙ্গী থেকেই হয়। তিনি সকল মুসলমানদের কিছুটা সময় হলেও এজতেমায় ব্যয় করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এবারো প্রায় ছয় হাজার জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বেরিয়ে যাবে।
চিকিৎসা সেবা ॥ গাজীপুর সিভিল সার্জন সৈয়দ মঞ্জুরুল হক জানান, গত কয়েকদিনের তুলনায় ইজতেমায় আগত রোগীর সংখ্যা শনিবার বেড়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় সিভিল সার্জনের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য ক্যাম্পগুলোতে ৫হাজারের বেশী মুসল্লীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। প্রচন্ড শীতের কারণে সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন মেডিকেল ক্যাম্পের প্রতিটিতেই রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে সকাল পর্যন্ত ২৩জনকে টঙ্গী সরকারী হাসপাতলে ভর্তি এবং ১৭ মুসুল্লিকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। ইজতেমার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকগণ জানান, এসব মুসুল্লীদের অধিকাংশই হৃদরোগ, অ্যাজমা, পেটেরপীড়া ও ঠান্ডায় আক্রান্ত হন। এছাড়া ইজতেমাস্থলের আশে-পাশের বিনামূল্যে বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্র গুলোতেও কয়েক হাজার মুসুল্লী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিৎসা ॥ শনিবার সকাল থেকে এজতেমা ময়দান সংলগ্ন ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলোতে মুসুল্লিদের চিকিৎসা নিতে ভিড় দেখা গেছে। মুসুল্লীদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য ময়দানের আশপাশে ও মন্নু নগর এলাকায় বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি পরিষদ, র্যাব’র ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প, গাজীপুর সিভিল সার্জন অফিস, হামদর্দ ওয়াক্ফ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিকেলস, টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, রওশন জাহান ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক কলেজ, বাংলাদেশ হোমিও প্যাথিক পরিষদ, জাতীয় ইমাম সমিতি, ইসলামি ফাউন্ডেশনের ইসলামি মিশন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনেরসহ বিভিন্ন ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। এলোপ্যাথি ছাড়াও মুসুল্লীরা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে তাদের ক্যাম্পে ভিড় করেছেন। অসুস্থ্যদের অধিকাংশই ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, আমাশয়, শ্বাসকষ্টের রোগী।
হকার ও পকেটমার আটক॥ বিশ্ব এজতেমা ও আপপাশ এলাকা থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত হকার ও পকেটমারকে আটক করেছে পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা।
মোনাজাতের দিন চলবে শ্যাটল বাস ॥ গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ জানান, শনিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে রবিবার আখেরি মোনাজাতের সময় পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কুড়িল বিশ্বরোড, আব্দুল্লাহপুর-কালিয়াকৈর সড়কে সাভারের বাইপাইল থেকে আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গীর স্টেশন রোড থেকে মীরের বাজার পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি ছাড়া সাধারন যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে আখেরি মোনাজাতের দিন রবিবার সকাল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোগড়া বাইপাস মোড় এলাকা থেকে এজতেমাস্থল পর্যন্ত মুসুল্লীদের সুবিধার্থে প্রায় অর্ধশত বিআরটিসি বাস ও ব্যাক্তি মালিকানাধীন আরো প্রায় অর্ধশত (এজতেমার স্টিকার লাগানো) শ্যাটল বাস চলাচল করবে।
বিশেষ ট্রেন ॥ বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে প্রায় ২১টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আখেরি মোনাজাতের আগে ও পরে সকল ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে। টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, রবিবার আখেরি মোনাজাতের দিন জামালপুর-টঙ্গী একটি, আখাউড়া-টঙ্গী একটি, টঙ্গী-ময়মনসিংহ, লাকসাম-টঙ্গী রুটে বিশেষ ট্রেন যাতায়াত করবে। এছাড়াও আখেরি মোনাজাতের আগে-পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে বলে জানিয়েছেন টঙ্গীর রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তা।
ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মো. গাউস আল মুনির জানান, বিশ্ব এজতেমা চলাকালে বিশেষ ট্রেন চালু হয়েছে। প্রতিটি ট্রেন টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে দুই মিনিট করে যাত্রা বিরতি করবে।
বিশ্ব এজতেমায় বিদেশি মুসল্লি ॥ গাজীপুর পুলিশের বিশেষ শাখার ইন্সপেক্টর মোমিনুল ইসলাম জানান, শনিবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্ততঃ ৮৮টি দেশের ৪ হাজার ৫৩১জন বিদেশী মুসল্লি ইতোমধ্যে টঙ্গীতে বিশ্ব এজতেমায় অংশ নিয়েছেন। এদের মধ্যে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৫৮জন মুসল্লী এজতেমা ময়দান থেকে ফিরে গেছেন। আরো বিদেশী মেহমান টঙ্গীর পথে রয়েছেন। বিভিন্ন ভাষা-ভাষী ও মহাদেশ অনুসারে এজতেমা ময়দানে বিদেশী মেহমানদের জন্য পৃথক বিদেশী নিবাস নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
পুলিশের প্রেস ব্রিফিং ॥ গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ শনিবার দুপুরে এজতেমা ময়দানের মিডিয়াসেলের সামনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে জানান, আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর পুলিশ প্রশাসন বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। এজতেমা ময়দানে যাতে কোন ধরনের নাশকতা কেউ করতে না পারে সেজন্য এবারের এজতেমা ময়দানে আরো বেশী সতর্ক অবস্থা নেয়া হয়েছে। নাশকতার বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে এবার বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। মোনাজাতের দিন অন্যান্য দিনের চেয়ে দ্বিগুন ফোর্স (দুই শিফটের ফোর্স এক শিফটে) মোতায়েন করা হচ্ছে। গত শুক্রবার লাখ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটেছে। মুসল্লিরা রাস্তায় নামাজ আদায় করেছেন। আমরা আশা করছি, আখেরী মোনাজাতের দিনও প্রচুর লোকের সমাগম ঘটবে। সেই কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। তিনি জানান, শনিবার দিবাগত রাত ১২টা হতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গী ব্রীজ থেকে ভোগড়া বাইপাস মোড়, টঙ্গী-কালিগঞ্জ সড়কে টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে নিমতলী অর্থাৎ মীরেরবাজার পর্যন্ত এবং কামারপাড়া সড়কে যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে।
যে সকল এলাকায় গাড়ি পার্কিং করা যাবে না ॥ এজতেমার আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে মুসল্লিদের সুবিধার্থে শনিবার বিকাল থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মহাখালি ক্রসিং থেকে টঙ্গী হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তার পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে, টঙ্গী-কালিগঞ্জ সড়কের টঙ্গী হতে মীরের বাজার পর্যন্ত, আব্দুল্লাহপুর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে, প্রগতি স্বরণিস্থ মধ্যবাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রগতি স্বরণিস্থ রাস্তার দুই পাশে যানবাহন পার্কিং করা যাবেনা।
ভিআইপিরা কে কোথায় মোনাজাতে অংশ নেবেন ॥ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বয়ান মঞ্চে বসে মোনাজাতে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবারের মতো এবারো দোয়া মঞ্চের পাশে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আখেরি মোনাজাতে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ। তবে এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুসুল্লীদের ভিড় এড়াতে ও নিরাপত্তার স্বার্থে টঙ্গীর বাটা সু’ ফাক্টরির ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ গ্রহনের পরিবর্তে ঢাকায় অবস্থান নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় এবারও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মোনাজাতে অংশ নিতে পারেন বলে সূত্রে জানা গেছে। একইভাবে বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া হোন্ডা (এটলাস) কারখানার ছাদে বসে অংশ নেয়ার পরিবর্তে ঢাকায় অবস্থান নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় মোনাজাতে অংশ নিতে পারেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়াশীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানসহ মন্ত্রী পরিষদের একাধিক সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের কর্মকর্তাগন জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুমসহ ময়দানের বিভিন্ন স্থানে উপস্থিত হয়ে মোনাজাতে অংশ নেবেন।