স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৪২টি স্তম্ভের মাত্র দুটির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ছয়টি স্তম্ভের পাইলিং শেষ এবং চারটির আংশিক শেষ হয়েছে। অন্যদিকে ১৪ স্তম্ভের পাইল ডিজাইন সংশোধন করা হচ্ছে। নতুন বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে পদ্মা সেতুর দ্বিতীয় স্প্যান বসানো হতে পারে। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণে সামগ্রিক কাজের ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে ভোটের আগে দেশের সবচেয়ে আলোচিত অবকাঠামো পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করাটা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে দুটি পিয়ারের উপর একটি স্প্যান বসিয়ে সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান করা হলেও নির্ধারিত সময় ২০১৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে পদ্মা সেতুর দ্বিতীয় স্প্যান বসানো হতে পারে। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণে সামগ্রিক কাজের ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। যথা সময়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করার আশাবাদ ব্যক্ত করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের টার্গেট যথা সময়েই সেতুর কাজ শেষ করবো। একটি স্প্যান ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে দ্বিতীয় স্প্যান বসানো হলেই ৭ থেকে ৮ দিন পরপর যথাক্রমে আরও স্প্যান বসানো হবে। এভাবে সেতুটিতে ৩৯টি স্প্যান বসানো হবে। সেতুমন্ত্রী আরো বলেন, আমাজান নদীর মতো পদ্মা হচ্ছে একেবারে অনিশ্চিত নদী। পদ্মার নিচে এতো বেশি অনিশ্চিত পরিস্থিতি, যেখানে গভীরতা মিলিয়ে টেকনিক্যাল কিছু সমস্যা আছে। তাই নির্দিষ্ট সময় দিয়েও আমরা সেই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারিনি। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে গেলেও আমরা আমাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে তৈরি করছি পদ্মা সেতু। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জকে বাস্তবায়িত করছে বাংলাদেশ সরকার।
এদিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেতুর কাজ শেষ হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী বলছেন, কাজ শেষ হতে আরও কয়েকমাস লাগবে। তিনি বলেন, সেতুর কাজ পুরোদমে চলছে। ভূমি কাঠামোর কারণে ১৪টি ‘পিয়ার’ বসানো নিয়ে নকশায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়েছে। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলামও নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, মাটির বিভিন্ন রকম গঠন থাকে, সময়ে তা পরিবর্তিতও হয়। এরকমই একটি বিষয় নিয়ে আমাদের এখন কাজ করতে হচ্ছে। শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনে জনবল ও যন্ত্রপাতি বাড়িয়ে হলেও নির্দিষ্ট সময়ই সেতুর কাজ শেষ করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে মূল সেতুর কাজ ৫২ শতাংশ এবং নদী শাসনের কাজ শেষ হয়েছে ৩৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর বাইরে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মোট ৪২টি পিয়ারের উপর ৪১টি স্প্যান বসবে। এর মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র দুটি পিয়ারের উপর স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৪০টি পিয়ার ও সেগুলোর উপর স্প্যান বসানোর কাজ এগিয়ে চলেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারের উপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে প্রথম স্প্যানটি বসিয়ে সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান করা হয়, যেটাকে ২০১৭ সালে পদ্মা সেতুর কাজে অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সেতুর অন্যান্য পিয়ারের কাজ এগিয়ে চললেও গভীরতার কারণে নদীর মধ্যের ১৪টি পিয়ার বসানোর কাজ নিয়ে নকশা পরিবর্তনের প্রয়োজন হওয়ায় এবং ‘টেস্ট পাইলিং’ শুরু করতে দেরি হওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতুর পিয়ার বসানোর জন্য ২৪০টির পাইলের মধ্যে ৮০টি পাইলের টপ সেকশনের কাজ শেষ হয়েছে।
এদিকে পদ্মা সেতুর মূল কাজের পাশাপাশি নদী শাসনের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রয়োজনীয় এককোটি ৩৩ লাখ কংক্রিট ব্লকের মধ্যে প্রায় ৩৫ লাখ ব্লক তৈরি হয়েছে। নদী শাসনের কাজ ৩৪ ভাগের বেশি শেষ হলেও এই সময়ে কাজের অগ্রগতি থাকার কথা ছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ। সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে ২০ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে, যাতে প্রকল্প কাজ আট মাস পিছিয়ে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ফলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই সেতুর কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে কাজে গতি আনতে কিছু সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪২টি পিয়ারের মধ্যে ১৪টির ‘পাইল ডিজাইন’ সংশোধনের আওতায় রয়েছে। এগুলো কবে পাওয়া যাবে সেবিষয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা জানতে চাওয়া হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনও কোনও পিয়ার ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে মাটির অবস্থা বিবেচনায় তা করা যাচ্ছে না। এজন্য নদীর মাঝের ওই ১৪টি পিয়ারের জায়গায় আরও পিয়ার সংখ্যা আরও বাড়িয়ে নতুন নকশা তৈরির কাজ চলছে। দ্রুতই এ কাজ শেষ করা হবে বলে জানান জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, ওই পিয়ারগুলোর পাইলিংয়ের কাজ আগামী মে মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে। তা না হলে বর্ষায় পানির তোড় বেড়ে যাওয়ায় ওই জায়গায় পাইলিংয়ে সমস্যা হতে পারে। মূল সেতু নির্মাণে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে কাজ শুরুর কথা থাকলেও তা করতে কয়েকমাস দেরি হয়ে যায়। যন্ত্রপাতি এনে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চে। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে মূল সেতু নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।