ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপনির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। দলের উচ্চপর্যায়ের লক্ষ্য কোনো একজন ব্যবসায়ী নেতা। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলামকে প্রার্থী করা হচ্ছে। তাঁকে এ বিষয়ে সবুজসংকেতও দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। অন্যদিকে আইনি জটিলতা কাটিয়ে ডিএনসিসির নির্বাচন হবে বা সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহীÑএ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নয় বিরোধী দল বিএনপি। এ জন্য তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে তৎপরতাও নেই। দলটির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণা করলে এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের তৎপরতা দেখে বিএনপি তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত তৎপরতা শুরু করবে। অতীতে বিএনপি সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ডিএনসিসির নির্বাচনেও অংশ নেবে। আর গত নির্বাচনের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবারও মূল বিবেচনায়।২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আনিসুল হক ৪ লাখ ৬০ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির তাবিথ আউয়াল পেয়েছিলেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ভোট। অবশ্য জবরদস্তি ও জাল ভোটের অভিযোগে বিএনপির প্রার্থী দুপুরের পর ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত ৩০ নভেম্বর লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেয়র আনিসুল হক মারা যান। এরপর ৪ ডিসেম্বর মেয়রের পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়। এর ফলে ৯০ দিনের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে।আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, গত শনিবার গণভবনে দলটির সভাপতিম-লীর বৈঠকে ডিএনসিসি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, তাঁর সঙ্গে আগ্রহী অনেকেই দেখা করেছেন, আগ্রহ দেখিয়েছেন। গণমাধ্যমেও অনেক নাম এসেছে। তিনি অনেকগুলো নামও বলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হচ্ছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম ও আরেক সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, ব্যবসায়ী আবদুস সালাম মুর্শেদী, আওয়ামী লীগের ঢাকা উত্তর কমিটির সভাপতি ও ব্যবসায়ী এ কে এম রহমত উল্লাহ, চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী, আওয়ামী লীগের ঢাকা উত্তর কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবাল প্রমুখ। তখন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, প্রকৃত আগ্রহী কে সেটা আগে জানা দরকার। আর কাকে প্রার্থী করলে জয়ী হওয়া যাবেÑএটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে জরিপও চালানো হচ্ছে।

সূত্র জানায়, এ সময় প্রধানমন্ত্রী নেতাদের প্রশ্ন করেন আতিকুল ইসলাম কেমন? তাঁকে নিয়ে এগোনো যায় কি না? এটাকেই দলীয় প্রধানের সবুজ সংকেত বলে মনে করছেন নেতারা।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত সপ্তাহে আতিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন। রাজধানীর ফার্মগেট, বিজয় সরণি ও মিরপুর এলাকায় আতিকুল ইসলামকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘মেয়র হিসেবে দেখতে চাই’ এমন বক্তব্যসংবলিত পোস্টারও দেখা গেছে। ওই সূত্র জানায়, আইনি জটিলতা থাকলেও ডিএনসিসিতে ভোট হবে ধরে নিয়েই প্রস্তুতি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ এগিয়ে রাখতে চায় দলটি। আতিকুল ইসলাম ব্যবসায়ী নেতা হলেও রাজনৈতিক পরিচিতি তাঁর নেই। এখন থেকেই দলীয়ভাবে তাঁকে পরিচিত করে তোলার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান বলেন, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজ-সব শ্রেণির প্রার্থীই আছে। প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।

আইনি জটিলতার কারণে নির্বাচন আটকে যেতে পারেÑএমন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ফারুক খান বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করেছে। এখন নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে। আইনি জটিলতার ব্যাপারে তো আওয়ামী লীগের কিছু করার নেই। দল হিসেবে তাদের কাজ হচ্ছে প্রস্তুতি নেওয়া। সেটাই তাঁরা শুরু করেছেন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আতিকুল ইসলাম সম্পর্কে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে তাঁর বদনাম নেই, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি আছে। পারিবারিকভাবেও তাঁদের একটা অবস্থান আছে। তাঁর ভাই তাফাজ্জাল ইসলাম প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিলের রায় দেন। তাঁর আরেক ভাই মইনুল ইসলাম সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রধান ছিলেন। বিডিআর বিদ্রোহের পর তাঁকে এই বাহিনীর প্রধান করা হয় এবং তাঁর আমলেই বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়। গুলশান-বারিধারার মতো অভিজাত এলাকা নিয়ে গঠিত এই সিটি করপোরেশনের জন্য পারিবারিকভাবে পরিচিত ও ব্যবসায়ীকে বেছে নিলে সুফল মিলবে।জানতে চাইলে আতিকুল ইসলাম বলেন, তিনি ব্যবসায়ী সংগঠনের রাজনীতি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ডিএনসিসির মেয়র পদে তাঁকে বিবেচনা করায় তিনি সম্মানিত বোধ করছেন। তিনি বলেন, প্রয়াত আনিসুল হক নগরের অনেক সমস্যা চিহ্নিত করে কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁকে সুযোগ দেওয়া হলে বাকি কাজ সম্পন্ন করবেন। আধুনিক নগরী গড়ে তেলার জন্য নতুন নতুন ভাবনা যুক্ত করবেন।

আগামী ফেব্র“য়ারিতে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী মাসে তফসিল ঘোষণা করা হবে। তবে ডিএনসিসিতে নতুন ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ার ফলে আইনি জটিলতায় ভোট আটকে যেতে পারেÑএমন একটা আলোচনা আছে। কারণ, ডিএনসিসির উপনির্বাচন হলে মেয়রের মেয়াদ হবে তিন বছর। কারণ, সিটি করপোরেশন কাউন্সিলের মেয়াদ পাঁচ বছরের। এর মধ্যে আনিসুল হক দুই বছর মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন। নতুন ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলর পদে ভোট হলে তাদের মেয়াদ কত দিনের হবেÑএ নিয়ে আইনি জটিলতা আছে।জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারেÑএমন আশঙ্কা থেকেই এই সময় নির্বাচনের বিপক্ষে অনেকে।

অন্যদিকে ডিএনসিসি নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ক বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত আছে। প্রার্থী বাছাইয়ে কাজ হচ্ছে। তবে কে প্রার্থী হচ্ছেন, এটা নিয়ে এখনো বলার মতো সময় আসেনি।আইনি জটিলতা সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আইনি জটিলতার কথা শুনেছি। এটা আমাদের বিষয় না। আর নির্বাচন হলেও আমাদের অসুবিধা নেই, না হলেও অসুবিধা নেই।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আনিসুল হকের চেয়ারে বসতে প্রচার যারা চালাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের ‘সায় পেয়েছেন’ বলে দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেছেন, গত সপ্তাহে আতিকুল গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। তখনই তাকে ‘গ্রিন সিগনাল’ দেওয়া হয়।এরইমধ্যে আতিকুলের ছবি সম্বলিত ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে তেজগাঁও ও ফার্মগেইট এলাকা।বৈঠকের বিষয়ে জানতে পক্ষ থেকে আতিকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, আমার ঠিক খেয়াল নেই। তবে, কোনো এক সময় দেখা হয়েছিল।নৌকা প্রতীক নিয়ে মেয়র নির্বাচন করতে নিজের আগ্রহের কথা সরাসরিই জানান তিনি।অবশ্যই কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমি কিছু নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছি। কিছু সম্মানিত সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছি। আগামী কয়েকদিন আরও করব।

আড়াই বছর আগে ঢাকা উত্তরের প্রথম নির্বাচনের আগেও একই প্রক্রিয়ায় অপ্রত্যাশিতভাবে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হয়েছিলেন আনিসুল হক।আনিসুল হকের মতো আতিকুলও তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ী। আনিসুল হক এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি হওয়ার পর এফবিসিসিআইর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।আতিকুলও বিজিএমইএর সভাপতি ছিলেন ২০১৩-১৪ মেয়াদে। এখন তিনি পোশাক খাতের শ্রম পরিস্থিতি ও পণ্যের মান উন্নয়নে গঠিত ‘সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ফর বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিজ’-সিবাইয়ের সভাপতি।গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন রাজনীতির জগতের বাইরে থেকে আনিসুলকে সমর্থন দিয়েছিল, বিএনপিও একইভাবে সমর্থন দিয়েছিল তাবিথ আউয়ালকে। ভোটের মাঝপথে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তাবিথ নির্বাচন বর্জন করেছিলেন।সেবার নির্দলীয়ভাবে ভোট হলেও সিটি করপোরেশনের আইন সংশোধন হওয়ায় এবার মেয়র নির্বাচন হবে দলীয়ভাবে। অর্থাৎ মেয়র প্রার্থীরা নৌকা-ধানের শীষের মতো দলীয় প্রতীক নিয়েই লড়বেন। আনিসুল হকের মৃত্যুতে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদটি এখন শূন্য। আগামী ২৮ ফেব্র“য়ারির মধ্যে এই পদে উপ-নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলে ইসি সে অনুযায়ী কাজ গোছাচ্ছে।