বহুল আলোচিত ট্রান্সকম গ্রুপের কর্ণধার লতিফুর রহমানের মেয়ে শাজনীন তাসনিম রহমানকে প্রায় ২০ বছর আগে ধর্ষন ও হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি শহীদুল ইসলামের রায় বুধবার রাতে কার্যকর করা হয়েছে। বুধবার রাত পৌণে ১০টায় গাজীপুরের কাশিমপুরে হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০১২সাল থেকে গাজীপুরের কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিল শহীদুল ইসলাম। রায় কার্যকরের পর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোঃ মিজানুর রহমান কারা ফটকে এসে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জানান, ফাঁসি কার্যকরের পর সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে শহীদুলের লাশ তার ভাই মহিদুল ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে লাশ নিয়ে রাতেই তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর থানার ডাংগাদূর্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় স্বজনরা। সেখানে পারিবারিক কবরাস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

কারা সূত্রে জানা গেছে, ফাঁসির রায় কার্যকরের সময় গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট রাহেনুল ইসলাম, কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট, গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ মো. মঞ্জুুরুল হক ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে জেলখানার প্রধান জল্লাদ রাজু ফাঁসির মঞ্চের লিভার টেনে ও তার তিন সহযোগীর সহায়তায় শহীদুল ইসলামের ফাঁসির দন্ড কার্যকর করেন। শহীদকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে আসার সময় সে কালেমা পড়ছিল। সন্ধ্যায় গোসল করানো হয়। পরে কারাগার ব্যারাকের মসজিদের ইমাম তাকে তওবা করান। কারাগারের পক্ষ থেকে শহীদুলকে আপেল ও কমলালেবুসহ বিভিন্ন ফল খাওয়ানো হয়। কিছুটা চিন্তিত দেখালেও সে অনেকটা স্বাভাবিক ছিল।

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার বিকাশ রায়হান জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন খারিজ হওয়ায় পরপরই কারাবিধি অনুযায়ী আদালতের দেয়া তার মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়।

তিনি আরো জানান, ফাঁসি কার্যকরের আগে বুধবার দুপুরে দন্ডপ্রাপ্ত শহীদুলের খালা, বড় বোন, ছোট ভাই মুহিদুল ইসলামসহ নিকটাত্মীয় পাঁচজন শহীদুলের সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাৎকালে শহীদ স্বাভাবিক থাকলেও তার খালা ও ভাই বোন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এক পর্যায়ে শহীদও আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। শহীদুল এসময় পরিবারের সদস্যদের উপদেশমুলক কথাবার্তা বলেন। অশ্রুস্বজল চোখে তারা কারাগার ত্যাগ করেন।

জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে গুলশানে লতিফুর রহমানের বাড়িতে খুন হন তার মেয়ে শাজনীন তাসনিম রহমান। শাজনীন তখন ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। আর শহীদ ছিলেন ওই বাড়ির পরিচারক। শাজনীন হত্যাকান্ডের পর পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হলে ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক কাজী রহমতউল্লাহ রায় দেন। রায়ে শাজনীনকে ধর্ষণ ও খুনের পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার দায়ে শাজনীনদের বাড়ির সংস্কার কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদার সৈয়দ সাজ্জাদ মইনুদ্দিন হাসান, হাসানের সহকারী বাদল, শাজনীনদের বাড়ির পরিচারক শহীদ, কাঠমিস্ত্রি শনিরাম মন্ডল ও গৃহপরিচারিকা দুই বোন এস্তেমা খাতুন (মিনু) ও পারভীনকে মৃত্যুদন্ড দেন বিচারক। আসামিদের মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) ওই বছরই মামলাটি হাইকোর্টে আসে। দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিলও করেন। ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০০৬ সালের ১০ জুলাই আসামি হাসান, শহীদ, বাদল, মিনু ও পারভীনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে। রায়ে অপর আসামি শনিরাম মন্ডল খালাস পান।

পরবর্তীতে হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করেন মৃত্যুদন্ড বহাল থাকা চার আসামি মইনুদ্দিন হাসান, বাদল, মিনু ও পারভীন। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ আদালত ওই চার আসামিকে আপিলের অনুমতি দেয়। অপর আসামি শহীদুল পরে জেল আপিল করেন। এর সাত বছর পর ২০১৬ সালের ২ আগস্ট আপিল বিভাগ রায় দেয়। রায়ে চার আসামিদের মধ্যে শহীদের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয় এবং অপর চারজন খালাস পায়। সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ৫মার্চ শহীদুল ইসলামের মৃত্যুদন্ডের রায় পর্যালোচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানি শেষে ওই আদেশ দেন।

চূড়ান্ত বিচারেও প্রাণদন্ড বহাল থাকায় শহীদ নিয়ম অনুযায়ী নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। প্রাণ ভিক্ষার আবেদনটি খারিজ হওয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হয় এবং আসামি শহিদের মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে। এরপর পরই কারাবিধি অনুযায়ী আদালতের দেয়া শহিদের মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়।